দক্ষিণ চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু টানেলকে কেন্দ্র করে খুলছে বেসরকারি বিনিয়োগের স্বর্ণদুয়ার। কারণ; এরইমধ্যে আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলায় বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা। বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ধারনা করছেন; টানেলের মাধ্যমে কর্ণফুলীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে দু’টি শহরকে এক করা গেলে বন্দর সুবিধাও আরো বেশি কাজে লাগানো যাবে। এতে চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রাম হয়ে উঠবে বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র। ওই টানেল প্রকল্পের ব্যয় অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলেয়ে পর্যায়μমে ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে বেসরকারি খাতে। প্রস্তাবিত চায়না ইকোনমিক জোনে ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের টার্গেট রয়েছে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিরও। ওদিকে রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, ফার্নেস ও সিমেন্ট শিল্পসহ ৩শ’৭১টি শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হবে এখানে। অন্যদিকে ১৩ একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে ট্যুরিজম জোনও। আগামি ২০২২ সালে ওই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য। তবুও এখন থেকেই বদলে যেতে শুরু করেছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের গোটা চেহারা। একাধিক সূত্র জানায়, টানেলকে ঘিরে গত দুই বছর ধরে বাড়ছে সরকারি- বেসরকারি বিনিয়োগও। সেরা সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ইয়ংওয়ান কর্তৃপক্ষ তাদের কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে (কেইপিজেড) বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। বর্তমানে এই ইকোনমিক জোনে ১৩টি কারখানায় কাজ করছে প্রায় ২৩ হাজার কর্মী। বর্তমানে ১৩টি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আগামি কয়েক বছরে আরো ৩টি বড় প্রতিষ্ঠান এভারটপ প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, গায়া প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি ও ডেই-গু প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি বড় ধরনের বিনিয়োগের লক্ষ্য নিয়ে তাদের ইউনিট স্থাপন করতে যাচ্ছে। এছাড়াও রপ্তানীমুখী জুতা, গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলেও এসব বিনিয়োগ হবে। সব মিলেয়ে পর্যায়μমে ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে বেসরকারি খাতে। কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমানও এ বিষয়ে একমত পোষন করেছেন। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে সরাসরি কক্সবাজারের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ফলে কমে যাবে চট্টগ্রাম শহরের যানজটও। বিমান বন্দরের সঙ্গে আনোয়ারা-কর্ণফুলীর দূরত্ব হবে মাত্র দুই কিলোমিটার। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীও তারা খুব সহজেই এখানে চলে আসতে পারবেন। এই বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে আনোয়ারায় বাস্তবায়ন হচ্ছে চায়না ইকোনমিক জোন। এই প্রকল্পে বেজার সঙ্গে চীন সরকারের জয়েন্টভেঞ্চার এগ্রিমেন্ট সম্পন্ন করার কাজ চলছে। আগামি এপ্রিল নাগাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের মূল কাজ উদ্বোধন করার সম্ভাবনা রয়েছে। ৭শ’৮৩ একর জমিতে প্রস্তাবিত চায়না এই ইকোনমিক জোনে ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের টার্গেট রয়েছে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের। ওদিকে রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, ফার্নেস ও সিমেন্ট শিল্পসহ ৩শ’৭১টি শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হবে। বিদেশি এই ইকোনমিক জোনের পাশাপাশি চলছে বেসরকারি ইকোনমিক জোনের প্রক্রিয়াও। সাদ মুছা গ্রুপ আনোয়ারায় ৪শ’ একর জমিতে করতে যাচ্ছে বেসরকারি ইকোনমিক জোন। এই শিল্পগ্রুপের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে ২৭টি বড় ও মাঝারি শিল্প কারখানা। শিল্পজোনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মোহসীন সাংবাদিকদের জানান, এই শিল্প জোনে বর্তমানে ৮টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে। ৪শ’ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত শিল্পপার্কে চায়না, কোরিয়া, জার্মানী, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বস্ত্রশিল্প, শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসন ও আইটি খাতে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। টানেল এলাকার কাছেই ইউনাইটেড গ্রুপের বিনিয়োগে তৈরি হচ্ছে ৩শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। আগামি দুই মাসের মধ্যে এটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এরআগে ২০১৭ সালের ২৮ এপ্রিল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। অন্যদিকে বাঁশখালীতে এক হাজার ৩শ’২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করেছে এস আলম গ্রুপ ও চীনের শেনডম ইলেকট্রিক পাওয়ার কন্সট্রাকশন ( সেপকো)। এতে ব্যয় হচ্ছে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম টানেল দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ নেটওয়ার্কেও বড় ভূমিকা রাখছে। সেই সঙ্গে কক্সবাজার পর্যন্ত বিকশিত হচ্ছে শিল্প-সম্ভাবনা। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালী মাতারবাড়ি এলাকায় দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর, কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি স্টেশনসহ জ¦ালানিভিত্তিক বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের যে শিল্প-কারখানা নির্মাণের কাজ চলছে টানেল তাদের সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, শিল্প সম্ভাবনার পাশাপাশি দেশি-বিদেশি অতিথিদের আকর্ষণ বাড়াতেও আনোয়ারায় পারকি সমুদ্র সৈকত আধুনিকায়নে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। ১৩ একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে ট্যুরিজম জোনও। প্রথম পর্যায়ে ৫ একর জমিতে হোটেল-মোটেল, শৌচাগার, নানা বিনোদন অনুসঙ্গ, শপিং জোনসহ পর্যটন কমপ্লেক্স তৈরি হবে। এতে ব্যয় হবে অন্তত ৩০ কোটি টাকা। এর বাইরে ৮ একর জমি উন্নয়নের পর ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেয়া হবে। সেখানে বহুতল বিশিষ্ট পাঁচ তারকা হোটেল নির্মিত হবে। চলতি বছরে পারকি বিচের উন্নয়নে ৬৩ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আনোয়ারার সংসদ সদস্য এবং ভূমি মন্ত্রী আলহাজ¦ সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ জানান, টানেল ইকোনমিক জোনসহ সরকারের বড় বড় মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। এ ছাড়া আনোয়ারা-কর্ণফুলীর উন্নয়নে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। টানেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে আনোয়ারা-কর্ণফুলীসহ পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম এমনকি কক্সবাজার পর্যন্ত শিল্প সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশি বিদেশি অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই টানেল নির্মাণ প্রকল্পের বোরিং কার্যক্রম উদ্বোধন করেন।