হাজার হাজার, লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের কল্যাণে এইডস নামক মারাত্বক রোগটি সম্পর্কে আমরা ইতোমধ্যে অবহিত হতে পেরেছি। জেনেছি রোগটির ভয়াবহতা সম্পর্কেও। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, গোটা বিশ্বের সরকার, হাজার হাজার সমাজসেবী সংস্থা, এনজিও কর্মী এবং স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে কর্মরত পন্ডিত ও বৈজ্ঞানিকদের হাজারো চেষ্টা জনগণকে সর্তক সচেতন করার লক্ষ্যে লক্ষ - কোটি টাকা ব্যয় করে বিশ্বব্যপি প্রচার চালানো শর্ত্বেও এইডস রোগীর সংখ্যা কম হওয়া তো দূরের কথা দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। অথচ প্রচার অভিযানের বহর দেখে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। এইডস এমনই একটা রোগ যাকে আমন্ত্রণ না করলে মানুষ আপনা আপনি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে না। ক্যান্সারও মারাত্বক ও নিরাময় অযোগ্য প্রাণঘাতী রোগ। কিন্তু এইডস এর সংগে ক্যান্সারের মূলগত পার্থক্য ( অবশ্য মিলও আছে অনেক ) হাজার সর্তক সচেতন থাকা শর্ত্ত্বে একজন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। অপর পক্ষে একজন সর্তক সচেতন মানুষের এইডস হওয়ার অবকাশ প্রায় শূন্য। এই তথ্য থেকে এটাই পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে যে, সচেতন মানুষের কাছে আশা করা গিয়েছিল, সেই সচেতনতা তাদের মাঝে দেখা যায়নি আর এহেন ব্যর্থতাই এই রোগটিকে বহাল রেখেছে আবার তাদের গতিকেও অব্যাহত রেখেছে। একথা আমরা এতদিনে জেনে গেছি যে, এইডস এমন একটা প্রাণঘাতী রোগ, যার কোন চিকিৎসা নেই। আর এ রোগটি অপ্রতিরোধ্য গতি দেখে মনে হচ্ছে বেশীর ভাগ মানুষ হয় জানেন না যে রোগটি আসলে কি কি কারণে এ রোগ মানুষের হয় অথবা কামনার আগুনে তারা এতটাই পীড়িত হয়ে পড়েন যে মৃত্যুর ভয়েও তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। দীর্ঘ জীবণের চেয়ে অদীর্ঘ উদ্দ্যাম যৌন জীবনই তাদের কাছে বেশী কাম্য। দুঃখ - কষ্টের দীর্ঘ জীবনের চেয়ে সুখ শান্তিময় সুস্থ জীবন প্রতিটি মানুষেরই কাম্য আর সেই সুখময়, শান্তিময় জীবন আনে সুকর্ম ও সদাচারের মাধ্যমেই। জাঁতি ধর্ম নির্বিশেষে একই কথা। কিন্তু আজকের যুবক যুবতীরা তথাকথিত অত্যাধনিকতার পিঠে সওয়ার হয়ে উদ্দাম যৌন জীবনে অভ্যস্ত পয়ে পড়েছে। ভুলে যাচ্ছে ক্ষণিকের মৌজÑমস্তিতে তার এই মারাত্বক রোগের স্বীকার হতে পারে। আর একবার এইডসÑএ আক্রান্ত হয়ে পড়লে সে রোগী যে কটা দিন বেঁচে থাকেন সে কটা দিন কার্যত, তাকে প্রতি মূহূত্বে মরতে হয়। প্রতি মূহূত্বে মরার এই আতঙ্ক নিয়ে তাকে এক ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়। তারপর মানুষের ঘৃণা, ধিক্কার, অপমান আর অপমৃত্যু, অবহেলা। এমনকি তার বাড়ীর মানুষ, পরিবার -পরিজন, বন্ধু-বান্ধবী, থেকে শুরু করে অধিকাংশ চিকিৎসকেরা পর্যন্ত তাদের উপেক্ষা করে চলেন। এক পরিসংখ্যানে এর ভয়াবহতা অনুমান করা যায়, প্রতি বছর সারা বিশ্বে ২৭ লাখেরও বেশী লোক এইচ আই ভি বা এইডস রোগে আক্রান্ত হন। বিগত ৫বছর ধরেই আক্রান্তের হার প্রায় একই রকম রয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে ২০১১ তে এ ধারা একটি পরিবর্তন শুরু হয়েছে। কারণ এইডস এর নতুন ঔষুধ আবিস্কার। ঔষুধ সেবনকারীদের কাছ থেকে নতুন করে আক্রান্তের হার ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত কম হয়েছে। এইডস আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের যে ধরনের ঔষুধ বর্তমানে দেওয়া হচ্ছে তাতে জন্ম নেওয়া সন্তানটি এইডস আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে। ইউ এস এইডে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে যানা যায় বাংলাদেশে এইডস আক্রান্ত লোকের সংখ্যা আনুমানিক ১১ হাজার। যা গোটা জনসংখ্যার ০.১ শতাংশের কম। আপাত দৃষ্টিতে এর প্রাদুর্ভাব কম মনে হলেও এইডসের ঝুঁকিতে আছে এমন জনগোষ্ঠির হার শতকরা ০.৭। ইউ এস এইডের রির্পোট আনুযায়ী ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যপি আনুমানিক ৬০ মিলিয়ন লোক এইচ আই ভি বা এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু বরণ করেছে ২৫ মিলিয়ন লোক, আর প্রতিবছর ২.৭ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে এইচআইভি/এইডস ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। নিশ্চিতভাবেই এর প্রভাব নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ যুবসমাজের উন্নয়ন ধারাকে ব্যহত করছে। এব্যপারে ব্যপক সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ১৪ হাজার নারী - পুরুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে অর্ধেকেই হলো যুবসমাজ যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। যুবসমাজের মধ্যে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এশিয়া মহাদেশেও এ রোগটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। এধারা অব্যাহত থাকলে যে কোন দেশের যুবসমাজ তথা আপামর জনসাধারণ মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
এইডস আসলে কি? এইডস- এর পুরো নাম অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্স সিন্ড্রোম। অ্যাকোয়ার্ড শব্দের- অর্থ হলো অর্জিত, কারণ এ ক্ষেত্রে একজন সুস্থ মাুষ অপর একজন রোগাক্রান্ত মানুষের কাছ থেকে রোগটি অর্জন করা। ইমিউনো ডেফিসিয়েন্স-র অর্থ হলো প্রতিরোধ বা প্রতিরক্ষাহীনতা, কারণ এইডস-এর ভাইরাস শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে (ইমিউন তন্ত্র যা রোগের সংগে লড়াই করে) নষ্ট করে দেয়। আর সিন্ড্রোম বলার অর্থ এই রোগের বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ হয়। আর অন্য দিকে এইচ আই ভি হলো হিউম্যন ইমিউনো ডিফিসিয়েন্সি। এটি এমন একটি ভাইরাস যা হলো এইডস রোগের মূল ঘটক। কীভাবে সক্রামিত হয় রোগটি? আমাদের শরীরের প্রকৃতিকভাবে এমন একটা সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে যাকে বলা হয় লিস্ফোসাইটিস। এইচ আই ভি ভাইরাসই এই লিস্ফোসাইটিস - এর ব্যবস্থার উপর তার অধিকার কায়েক করে ফেলে। ফলে লিস্ফোইটিস এর সংক্রামক ভাইরাসকে প্রতিহত করতে পারে না। এইডস এর ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করার পর বেশ কয়েক বছর তা চুপচাপ সুপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। শুধু তাই নয়, শরীরে এমন কোন লক্ষণও প্রকাশ পায় না। যাতে রোগীকে পরীক্ষা করে এই রোগকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। তারপর একদিন হঠাৎ করে যখন এই ভাইরাসের প্রভাব শরীরে শুরু হয় তখন প্রথম দফায় গুরুতর সংক্রামণ হতে দেখা যায়। শরীলে তখন এক এক করে বেশ কিছু লক্ষণ দৃষ্ট হয়। যেমন- ১. গায়ে একনাগাড়ে জ¦র লেগে থাকা। ২. দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পাতলা দাস্ত হয়ে থাকা। ৩. ধীরে ধীরে শরীরের ওজন কম হতে থাকা। ৪. মুখে ও গলায় ফোসকা পড়তে থাকা। ৫. মংসপেশী এবং শরীরে বিভিন্ন জোড়ে ব্যথা শুরু হওয়া, ৬. দাদের মতো সারা শরীরে লাল লাল চাকাচাকা দাগ হওয়া। ৬. লাসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া। ৭. মানসিক অবস্থার বিকৃতি ভুলে যাওয়া। ৮. অসম্ভব দুর্বল ও ক্লন্তি বোধ হওয়া। অলস্য ভাব, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। কী করে হয় এইডস? এইডস হওয়ার প্রধান দুটি কারণ। এক অপরিচিত সঙ্গী বা সঙ্গীনির সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা। দুই, শরীরে এইচ আই ভি সংক্রামিত রক্ত প্রবেশ করা। পতিতা বা কলগার্লদের সাথে অবাধ যৌন কার্যকলাপে মিলিত হওয়া। পশ্চিমা সাংস্কৃতি, অবাধ যৌনমিলন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউবের মাধ্যমে, লীল ছবির যুগে এক শ্রেণীর যুবক যুবতীরা গভীর রাত পর্যন্ত ওই সব যৌন উত্তেজক ঔষুধ সেবন করে, কিংবা ছবি দেখে তারা অবৈধ অবাধ যৌন মিলনে জড়িয়ে পড়ছে বলে তারাই এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই তরুণ প্রজন্ম এইচআইভি/এইডস সংক্রান্ত তথ্য, সেবা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। অবশ্য বর্তমান সরকার বেশ কিছু পর্ণ ওয়েবসাইড বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা সত্যি ভাল কাজ সরকার প্রশংসার দাবীদার। সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আপামীতে সকল পর্ন সাইড বন্ধ করে যুব সমাজকে বাঁচান। বিশ্বব্যপি ক্রমবর্ধমান আর্থসামাজিক বৈষম্য যুবসমাজের মধ্যে এইচ আই ভি সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য গ্রহন, অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, বানিজ্যিক ও ভাসামান যৌন বাসনা, ঝঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠি সাধারণ মানুষের আন্তঃসম্পর্ক, অনিরাপদ যৌন মিলন, কনডম ব্যবহারে অনীহা, নারী পুরুষ বৈষম্য, অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবা, যুবসমাজের মধ্যে নেশার আধিক্য, এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা ও তথ্যের অভাব, দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা, শ্রমিক অভিবাসন ও মানব পাচার ইত্যাদি। যুব সমাজের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুনদের মধ্যে গ্রামের শতকরা ৪৮ এবং শহরে শতকরা ৪৫ ভাগ তরুন ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে বিবাহপূর্ণ যৌন অভিজ্ঞা লাভ করেছে। এদের অধিকাংশই এই যৌন অভিজ্ঞতা শুরু তাদের মেয়ে বন্ধুদের সাথে (শতকরা ৫৮ ভাগ) এবং পেশাদার যৌনকর্মীদের সাথে (শতকরা ২৬ ভাগ) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ তরুণ এবং ২১ ভাগ তরুণীদের মধ্যে যৌন রোগের লক্ষন পাওয়া গেছে। যুব সমাজের মধ্যে যৌনরোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও লক্ষণ সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সীমিত। এইডস প্রতিরোধ সম্পর্কে আমাদের যুবসমাজের অধিকাংশেরই সঠিক ধারণা নেই। এইচআইভি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অঙ্গিকারের মাধ্যমে দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণ আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে এই যুব সমাজ যেমন আজ ঝঁকিপূর্ণ তেমনই এই যুব সমাজই হতে পারে আগামি দিনের আশার আলো। এই যুব সমাজই আমাদের শক্তি এবং এরাই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে ডিজিট্যাল সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে, মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ গড়তে।
লেখক- প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়