‘আইন সবার জন্য সমান’ এ কথাটি ভাবতে মাঝে মধ্যে সত্যি সত্যি হাঁপিয়ে উঠতে হয়। কারণ কখনো শক্তির কাছে আইন দুর্বল হয়ে পড়ে। কখনো স্বার্থে কিংবা অর্থের কাছে আইন অসহায় হয়ে যায়। আবার কখনো কখনো স্বয়ং বিচারকের একচোখা কিংবা পক্ষপাতিতের কবলে পড়ে আইন অতলে হাবুডুবু খায়। এসব নানাবিধ অশুভ ফাঁদে আইনের কাঁতরানো দেখে নিজেকে সহসায় হারিয়ে ফেলি বিবেকের অজান্তে। এমনই আইন ভাঙ্গার মহোৎসব চলছে দেশের সীমান্তবর্তী যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙ্গনকবলীত জনপদখ্যাত জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায়।
এ উপজেলায় সরকারি বরাদ্দকৃত উন্নয়ন প্রকল্পে অবৈধ ড্রেজার মেশিন ‘বৈধ’ হলেও বেসরকারি কিংবা বসতবাড়ি উঁচুকরণে গরীব মানুষের ড্রেজার অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) একচোখা বিচারে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে খোদ সরকারি বরাদ্দকৃত উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করলেও বসতবাভিটা উঁচুকরণ কাজে ব্যবহৃত স্থানীয় গরীব মানুষের ড্রেজার মেশিনগুলো প্রায় প্রতিনিয়তই অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় সরকারের অতিদরিদ্রদের জন্য কাজের বিনীময়ে কর্মসৃজন কর্মসূচী, কাজের বিনীময়ে টাকা (কাবিটা), কাজের বিনীময়ে খাদ্য (কাবিখা), গুচ্ছগ্রাম-আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণসহ টেস্ট রিলিফ (টিআর) প্রকল্পে শ্রমিকের পরিবর্তে ড্রেজার মেশিন দিয়ে মাটি কাটা হলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আইনগত পদক্ষেপ নিতে কোনো ধরনের গরজ পরিক্ষিত হচ্ছে না।
জানা যায়, উপজেলার দশানি নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করে গাইবান্ধ ইউনিয়নের চন্দনপুর গ্রামে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ প্রকল্পের মাটি কাটা হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাটি কাটার কাজ শুরু আগে স্থান পরিদর্ষণ করেছেন ইউএনও মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। ওই প্রকল্পের সংলগ্ন চন্দনপুর এলাকায় গত ২২ এপ্রিল ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালন করে নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করায় আগুন লাগিয়ে তিনটি ড্রেজার মেশিন পুড়ে ধ্বংস করেন ইউএনও সাহেব।
প্রকল্পের সংলগ্ন টুংরাপাড়া ব্রিজ এলাকায় গত ৩১ মার্চ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলণ করার অপরাধে ইউএনও নিজের হাতে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় দিয়ে হাইদর আলী ও শহিদুল্লা নামে দুই ড্রেজার মেশিন মালিককে আটক করে থানায় নিয়ে যান। এ দিন আগুন লাগিয়ে দশানি নদীতে ভাসমান দুই ড্রেজার পুড়ে ভূস্মীভূত করেছেন তিনি। একই সময় ড্রেজার গোরস্থানে মাটি ভরাট হচ্ছে, এমন কথা বলার অপরাধে আব্দুর করিম নামে এক যুককেও ইউএনও’র হাতে মারধরের শিকার হতে হয়েছে। মারধরের শিকার ওই যুবক স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাকছুদুর রহমানের ভাতিজা। পরে বিকালে ইউএনও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করলে আটককৃত ওই দুই ড্রেজার মেশিন মালিক ৮২ হাজার টাকা দিয়ে মুক্তি পায়।
অন্যদিকে, উপজেলার কুলকান্দি ইউনিয়নের ঝিগাতলা গ্রামে, সাপধরী ইউনিয়নের চেংগানিয়া ও গাইবান্ধা ইউনিয়নে নাপিতেরচর এলাকায় গত বছর গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়। একই অর্থবছরে নির্মাণ করা হয় একাধিক আশ্রয়ণ প্রকল্পও। সরকারিভাবে গৃহিত এসব প্রকল্পের মাটি করা হয়েছে নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করে। যা কার্যাদেশ বহির্ভূত।
দরিদ্র ও ভূমিহীন মানুষদের বাসস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের বিশেষায়িত একটি উদ্যোগ গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প। প্রসঙ্গত, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে, ভূমিহীন পরিবারকে সরকারি খাস জমিতে পুনর্বাসন করা। পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা রাখা। প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীনরা পায় বাসস্থান, অন্যদিকে কাজের বিনীময়ে শ্রমিকরা পায় খাদ্যশস্য। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হওয়া এ প্রকল্প জেলা প্রশাসনের পক্ষে স্থানীয়ভাবে তদারক করেন ইউএনও।
দারিদ্রপিড়িত এ উপজেলায় অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচী প্রকল্পেও শ্রমিকের পরিবর্তে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন মাটি কাটার বিস্তর অভিযোগ। গাইবান্ধা সুরুজ্জাহান উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট করতে কর্মসৃজন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের শ্রমিকের পরিবর্তে শিয়ালদহ নদী থেকে ড্রেজার বসিয়ে মাটি কাটা হয়। এতে শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্প মজুরি থেকে বঞ্চিত হন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, উপজেলাধীনস্থ বিভিন্ন নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করার লক্ষ্যে মাঝে মধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন ইউএনও। এ সময় নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করার অপরাধে তিনি ইতোমধ্যে অসংখ্য ড্রেজারে আগুন লাগিয়ে পুড়ে ভূস্মীভূত করেছেন। এছাড়া একই সময় কোড়াল ও দা দিয়ে কোপিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে ড্রেজারের হাজার হাজার ফুট পাইপ। এতে অনেক গরীব ড্রেজার মালিকরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সরেজমিনে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ইসলামপুরে কাবিটা কর্মসূচীর আওতায় প্রথম পর্যায়ে ১নং প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় কুলকান্দি হার্ড পয়েন্ট থেকে পাথর্শী সীমানা পর্যন্ত বাধঁ কাম রাস্তা নির্মাণ। ৬ লাখ টাকা বরাদ্দের এ প্রকল্পের সভাপতি কুলকান্দি ইউনিয়নের পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান সনেট। এ প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে শ্রমিকের পরিবর্তে যমুনা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করে।
এছাড়া কাবিখা কর্মসূচীর আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ১নং প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় কুলকান্দি হার্ড পয়েন্ট হতে পাথর্শী সীমানা পর্যন্ত বাকী অংশ বাঁধ নির্মাণ। ১৬ মেট্রিক টন চাউলের এ প্রকল্পটির কাজ করা হয়েছে ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলন করে। ১০ মেট্রিক চাউলের বিপরীতে ২নং প্রকল্প দেওয়া হয় বেলগাছা ইউনিয়নের বরুল হাসমতের বাড়ী পিছনে রাস্তা হতে ইদ্রিস মাস্টারের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা মেরামত। ১০ মেট্রিক টন চাউলের বিপরীতে ৩নং প্রকল্প ইসলামপুর গুঠাইল পাকা রাস্তা হতে ফৈলামারী মিন্টু মিয়ার বাড়ী হয়ে ফৈলামারী ঈদগাহ্ মাঠ পর্যন্ত রাস্তা উন্নয়নে করা হয়েছে অনিয়ম। ১০ মেট্রিক টন চাউলের বিপরীতে ৪নং প্রকল্প দেওয়া হয় সাপধরী জহুরুল ইসলামের বাড়ী হতে চেঙ্গানিয়া ও আকন্দপাড়া সংযোগ রাস্তা পর্যন্ত উন্নয়ন। একই পরিমাণ চাউলের বরাদ্দে ৫ নং প্রকল্প দেওয়া হয় কাজলা মোল্লা বাড়ী হতে হরিণধরা বাঁধ পর্যন্ত রাস্তা মেরামত। ১২ মেট্রিক টন চাউলের বিপরীতে ৬নং প্রকল্প পচাবহলা পাকা রাস্তার হালিমের দোকান হতে বক্করের বাড়ী হয়ে খোরশেদের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের। এসব প্রকল্পে দিনহাজিরা শ্রমিকের পরিবর্তে কোথায় কাজ করা হয়েছে ভটভটি গাড়ি দিয়ে, কোথায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে। আবার কোথাও করা হয়েছে নামমাত্র কাজ।
অন্যদিকে ‘টাকা নিয়ে কাজ না করলে সে টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত নেওয়া হবে। অন্যথায় আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এমন বাহারি-রকমারি স্লোগান ইউএনও চারিদিকে চাউর করলেও প্রকল্পের অর্থ উত্তোলন করে তছরূপের ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কোনো ধরনের হিম্মত দেখাতে পারেননি তিনি। বরং বাহারি-রকমারি স্লোগানেই উন্নয়ন প্রকল্পের ‘নির্ভেজাল অনিয়ম-দুর্নীতির’ সমাধান খোঁজছেন প্রজাতন্ত্রের ওই কর্মচারি।
তবে একটি কথা এখানে না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে এ উপজেলায় একটি ইউনিয়নে ‘আসল ভিক্ষুক’ খোঁজে বের করতে আন্তরিকতার কোনো ধরনের খাটতি নেই, এমনটি প্রমাণ করে জনগণকে জানান দিয়েছেন ইউএনও সাহেব। তিনি পবিত্র কোরআন শরীফ উপস্থানের কথা বলে ‘আসল ভিক্ষুক’ খোঁজে বের করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু গুচ্ছগ্রাম, আশ্রয়ন ও হতদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচী প্রকল্পের শ্রমিকদের দিয়ে কাজ না করিয়ে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করে তা তছরূপের ঘটনা ঘটলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন উপজেলা কমিটি’র সভাপতি হিসেবে ইউএনও’র আইনগত পদক্ষেপ নিতে কোনো ধরনের গরজ পরিলক্ষিত হয়নি। বরং হতদরিদ্রদের কর্মসৃজন কর্মসূচী প্রকল্পের লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরায় গণমাধ্যকর্মীর ওপর তার চটে যাওয়া খবর জাতীয় দৈনিকের। অভিযোগ রয়েছে, একটি কুচক্রীমহল সাংবাদিক পরিচয়ে অপরাধীদের সাথে সক্ষতা কাজে লাগিয়ে সাংবাদিক নাম ভাঙ্গিয়ে ও অফিসারের নামে প্রতিনিয়তই দরিদ্র ড্রেজার মালিকদের কাছে ‘উপরি’ হাতিয়ে নেওয়ারও।
আমরা মনে করি, আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই আইন। সেই আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়াটাই সঙ্গত। কিন্তু আইনের ভেতরে যদি রয়ে যায় ফাঁক-ফোকর, তবে তা গলিয়ে প্রবেশ করতে পারে বেআইনী কাজ-কারবার। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে যেমন হ্রাস পেতে বাধ্য অপরাধ, দুর্নীতি, অনিয়ম তেমনি জনস্বার্থবিরোধী তৎপরতাও ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ হোক এটা কারও চাওয়া হতে পারে না। উন্নয়ন প্রকল্পে নির্ভেজাল অনিয়ম-দুর্নীতি, নিষিদ্ধ গাইড বই অবাধে বিক্রি, জমজমাট জুয়ার আসর, শিশু শ্রম, ফলমূলে ফরমালিনসহ কেমিক্যাল মেশানো, ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রি মারাত্মক অপরাধ হলেও তা নিরসনে যদি যথাযথ আইন প্রয়োগ করা না যায়, তবে ভয়াবহ হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। এর মূলোৎপাটন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধ করে যদি অপরাধী পার পেয়ে যায়, তবে অপরাধের বিস্তার রোধ দুষ্কর বরং অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যধিক। আর যত্রতত্র অবাধে আইন ভাঙ্গার মহোৎসব চলবে, তা মেনে নিতে পারে না সমাজ, রাষ্ট্র। অথচ এসব ঘটনায় অনেক গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে আইনের প্রয়োগ যথাযথ না হলে এর ভয়াল থাবা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
ভেজালবিরোধী অভিযান, ইভ টিজিং প্রতিরোধ, দুর্নীতিমুক্ত পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠান, সুষ্ঠু নির্বাচন ও জানমাল রক্ষায় দ্রুত বিচারের জন্য ২০০৯ সালে প্রণয়ন করা হয় মোবাইল কোর্ট তথা ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধ দমন যেখানে মুখ্য সেখানে স্বয়ং বিচারকের আইন ভাঙ্গার প্রবণতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ জনগণের জন্যই যদি আইন হয়, তবে জনস্বার্থ রক্ষাটাই জরুরি। মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধই যেখানে প্রধান সেখানে অপরাধীর পক্ষে যায়, এমন পদক্ষেপ জনস্বার্থবিরোধী। সব আইনের যথাযথ প্রয়োগই দেশবাসীর কাম্য।
[এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক]