অনাচার আর অন্যায় যখন একটা ভূখ-কে গ্রাস করে, কারও কাছে মানুষের আশ্রয় পাবার কোনো আশা থাকে না, তখনই পরিত্রাতা হিশেবে হাজির হন কোনো মহামানব। এমন বিশ্বাস নিজের অজান্তেই লালন করে পৃথিবীর সব সমাজের মানুষ। রবীন্দ্রনাথও করতেন। ‘সভ্যতার সংকট’ লেখায় এমনই এক মহামানবের পদধ্বনির কথা বলেছেন সে-কারণে। মানুষের এই বিশ্বাসের কারণেই সুপারহিরোদের এত জনপ্রিয়তা। আসলে মানুষের অসহায়ত্ব আছে বলেই সুপারহিরোরা এখনও মনের কোণে টিকে আছে। সুপারহিরো কমিকসের গথাম সিটির সঙ্গে ঢাকার মিল আছে। গথামের মতো এটিও পাপে নিমজ্জিত এক শহর। তবে অন্যায়কারীকে শায়েস্তা করতে এই শহরের কোনো ব্যাটম্যান নেই, বরং আছে আলফা। আলফা সুপারহিরো তো নয়ই, এমনকি সাধারণ হিরোও নয়। বসবাস মহানগরের এক প্রান্তের একটি ঝিলের ঠিক মাঝখানে। এলাকায় পরিচিত আর্টিস্ট হিশেবে। রিকশা পেইন্টিং আর বিলবোর্ড এঁকে দিন কাটে। একটা গাধার পিঠে শিল্পের সরঞ্জাম চাপিয়ে নগরে কাজে বের হয় সে।
লম্বা চুল আর খাটো প্যান্ট পরা আলফা নাগরিক ক্লেদ, হিংসা আর অমানবিকতার প্রত্যক্ষদর্শী। কিছু করার ক্ষমতা না থাকলেও সে এসব পাপ পঙ্কিলতাকে ছুঁয়ে যায়। আশপাশের মানুষের ভেতরে নতুন এক মানবিকতার সন্ধান করে সে।
আলফার প্রতিটি দৃশ্যই এক-একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলচ্চিত্রের নাম আলফা। গ্রিক বর্ণমালার প্রথম অক্ষর, যার অন্য এক অর্থ সূচনা বা আরম্ভ। একইসঙ্গে আলফা খ্রিস্ট ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের কাছে পবিত্র এক নিদর্শন। ঈশ্বর বলেছিলেন, আমিই আলফা অর্থাৎ শুরু। আবার আলফা এমন এক অদৃশ্য আলো যা অন্ধকারে বিচ্ছুরিত হবারও ক্ষমতা রাখে। এমন বহুমুখী ব্যঞ্জনা আছে বলেই পরিচালক নাসির উদ্দিন ইউসুফ তার নতুন চলচ্চিত্রের এমন নাম বেছে নিয়েছেন?
প্রায় যিশুখ্রিস্টের মতো চেহারা-সুরত আলফার। নগরের এক প্রান্তে যে ঝিলের ভেতরে বাঁশের বাড়িটিতে সে থাকে তার চারপাশে কেউ নেই। নগরে যা কিছু স্নেহ, মায়া-মমতা অবশিষ্ট আছে তা এই ঝিল আর ঝিল সংলগ্ন ছোট্ট বস্তিটার মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ। আর তাই বেঘোরে মারা পড়া এক যুবকের লাশও আলফার বাঁশের ঘরের নিচে এসে পড়ে।
নাসির উদ্দিন ইউসুফের আলফা চলচ্চিত্র বহুস্তরে সজ্জিত এক মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র। এতে টানা কাহিনি নেই। নেই সময় ও দৃশ্য পরম্পরা। তবু এই সিনেমা এতটুকু ক্লান্তিকর নয়। এদেশের নানা রাজনৈতিক ও সামিজিক বিপর্যয়ের মাঝে দর্শককে টেনে নিয়ে গেলেও এতে বিবৃতি নেই। বরং আলফার প্রতিটি দৃশ্যই এক-একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আলফায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন চট্টগ্রামের ছেলে আলমগীর কবির, দোয়েল ম্যাশ, এটিএম শামসুজ্জামানসহ অনেকে। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে নির্মিত এ চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় আছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। প্রযোজনা করেছেন ফরিদুর রেজা সাগর ও পরিচালকের কন্যা এশা ইউসুফ।
কে আলফার বাবা-মা তা জানার উপায় নেই। মহররমের মিছিলে হারিয়ে যাওয়া শিশু আলফার স্থান হয়েছিল এক চিত্রশিল্পীর কাছে। যার পেশাও ছিল আলফার মতো সাইনবোর্ড আর বিজ্ঞাপন চিত্র আঁকা। শৈশবের নানা অভিজ্ঞতা বারবারই আলফাকে তার অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কীর্তন দলের হরগৌরী বারবার এসে উপস্থিত হয় তার সামনে। তাই প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও নিজের মাঝে হরগৌরী অর্থাৎ শিবের অস্তিত্ব খুঁজে পায় সে। শিব অর্ধনারীশ্বর। এ কারণে নারী আর পুরুষের সম্মিলিত রূপ হিশেবে নিজেকে ভাবতে চায় আলফাও। কারণ তার কাছে এটাই সর্বব্যাপী প্রকৃতির প্রতীক।
আলফার এই আত্ম-অনুসন্ধানের মাঝে এসে দাঁড়ায় সমকালীন বাংলাদেশ, যেখানে মৃত্যু প্রাত্যহিক ব্যাপার, অতি সাধারণ আর তুচ্ছ এক ঘটনা মাত্র।
রিকশা গ্যারেজে বিক্রির জন্য আলফার নিয়ে যাওয়া রিকশা পেইন্টিং-এর মধ্যে ধর্মীয় উপাদান বেশি করে আনার পরামর্শ দেন গ্যারেজ মালিক। তার এই কথার আবহে ভেসে আসছিল টেলিভিশনের খবরের শব্দ। সেখানে আরও এক ব্লগারকে হত্যা করার খবর প্রচার হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের নতুন বাঁক বদল আলফা প্রত্যক্ষ করে নিশ্চয়। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না সে। কারণ নাগরিকদের কাছে তার কি-বা মূল্য আছে।
বিশাল ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় পথ চলতে গিয়ে আলফা গাধার বাচ্চা বলে গালি খায়। অথচ ঝিলের ধারের বস্তি এলাকায় সবাই তাকে চেনে আর্টিস্ট হিশেবে। সেখানে আঁকা-আঁকি, কালি নামের এক হিজড়া, ছোট ছেলে-মেয়ের দল, পোশাক কারখানার মেয়েরা আর খাবার নিয়ে যাওয়া তরুণী গোলেনুরকে নিয়ে নির্বিবাদী জীবন হতে পারত তার। কিন্তু তা হয় না। ঘরের বাঁশের খুঁটির সঙ্গে এসে ঠেকা লাশ নিয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে আলফা। কে খুন করল এই যুবককে, কেনই বা করল? জঙ্গি নাকি ক্রসফায়ারের নামে রাষ্ট্রীয় হত্যাকা-?
আলফা ছাড়া প্রথমে ওই লাশ আর কেউ দেখতে পায় না। পুলিশকে খবর দিলেও তারাও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় প্রথম দিকে। সে তার ঘরের খুঁটি থেকে লাশটা সরিয়ে দিলেও বারবার ফিরে আসে। এই শহরে আলফা ছাড়া আর তার আশ্রয় কোথায়। শেষে আলফা লাশের সঙ্গে বাতচিত শুরু করে। জানতে পারে তার নাম সোলায়মান। শহরের একটার বস্তিতে থাকত। ছোট্ট একটা ছেলেও আছে তার। আলফা সোলায়মানের বস্তিতে যায়, কিন্তু তার স্ত্রীকে খবরটা দেওয়া হয় না। সোলায়মানের মৃত্যু হয়েছে এ কথা বলা হয় না। সাধুখালী গ্রামে সোলায়মানের বাড়িতেও যায় সে, যেখানে অন্ধ মা অপেক্ষা করে আছে ছেলের জন্য।
এভাবে আলফা নামহীন এক লাশের অভিভাবক হয়ে ওঠে। আর এর মধ্য দিয়ে কেবল একটি লাশ নয় বরং শত শত নামহীন লাশের অভিভাবকত্ব নেয় সে। তার প্রশ্ন এত লাশ কোথা থেকে আসে? কারা খুন করে, কেন করে?
জীবন-মৃত্যুর ভেতর দিয়ে মানুষের অন্তহীন যাত্রা দেখানো হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।
পোশাক কারখানায় অগ্নিকা-ে মৃত নারী শ্রমিক কিংবা পেট্রোল বোমায় পুড়ে অঙ্গার হওয়া বাসযাত্রী সবাই আলফার স্বজনে পরিণত হয়। তারা যেন মরে গিয়ে বলে যায়, মানবিকতার কণামাত্রও অবশিষ্ট নেই কোথাও। আলফা তখন শোকে বেদনায় নিজের ক্যানভাসের ওপর রং ছিটিয়ে শিবের মতোই তা-ব করে। এই আহাজারি এই মর্সিয়া আলফাকে নতুনভাবে চেনায়। সে হয়ে ওঠে সবার।
বাংলা চলচ্চিত্রে আলফা এক নতুন সংযোজন। পারাজানভের ‘কালার অব পুমিগ্রান্ট’ কিংবা তারকোভস্কির ‘আন্দ্রে রুবলেভ’ এর মতো জীবন-মৃত্যুর ভেতর দিয়ে মানুষের অন্তহীন যাত্রা দেখানো হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।
দেশকাল এই চলচ্চিত্রে মুছে গেছে শেষ পর্যন্ত। ভারতীয় হরগৌরীর মিথের পাশাপাশি গ্রিক হারমাফ্রোডাইটও এখানে হাজির। কীর্তনের পাশাপাশি মোৎসার্টের সুরও প্রবহমান এখানে।
আলফা চরিত্রে অভিনেতা আলমগীর কবির কোথাও পরিমিতি ছাড়িয়ে যান নি। কেবল তিনি নন, বিস্মিত হতে হয় প্রত্যেকের অভিনয় দেখেই।
সোলায়মানকে অথৈই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার আগে আলফা আর ডোমের মধ্যে কথোপকথনের একটা দৃশ্য ছিল। সেখানে ডোম বলে, যা দিয়ে লাশের জাত-ধর্ম চেনার, সেটা শেয়াল-কুকুরে খেয়ে নিয়েছে। তখন আলফার উত্তর, তবে তো সে এখন শুধুই মানুষ। এই সিনেমা শেষ পর্যন্ত দর্শকদের সেই দিকেই নিয়ে যায়, যেখানে পরিচয়হীন মানুষেরা, শুধুই মানুষ হিশেবে ¯্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে চায়। তার কাছে আশ্রয় খোঁজে। দেখতে দেখতে মন ভরে ওঠে। মনে হয় এমন একটা সিনেমার জন্যই এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম।