আমাদের বাড়িতে হঠাৎ কোত্থেকে একজোড়া তক্ষকের আবির্ভাব ঘটল। দিন-রাত সময় নেই, অসময় নেই সকাল-দুপুর-বিকেল-রাত ‘হক্কেঙ’ ‘হক্কেঙ’ শব্দে ডেকে ওঠে। এদের ডাকে দুপুরে বাবার ভাত ঘুমটা যখন ভেঙে যায় বাবা বিরক্ত হন, মাঝরাতে মেয়েটা কেঁদে উঠলে বউ বিরক্ত হয়। এগুলোকে ধরে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসতে পারি না বলে বউ আমার উপর রাগ করে। আমি চুপ করে ঘুমানোর চেষ্টা করি। তর্ক করলে লঙ্কাকা- বেঁধে যাবে। রাতে আর ঘুমাতে হবে না।
ধরে দু’এক বার যে গ্রামের শেষ প্রান্তে শাখা-প্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র বট গাছটার খোড়লে ছেড়ে দিয়ে আসি নি তা নয়। কিন্তু দু’দিন না যেতেই কোনো এক দুপুরে এদের ডাক শুনে বুঝতে বাকি থাকে নি যে আমার চেষ্টা বৃৃথা গেছে। আবার ফিরে এসেছে।
অসাধারণ বর্ণিল আলপনা আঁকা দেহে তক্ষকগুলো কখনও কখনও ঘরের বাঁশের বেড়ায় ঘুরে বেড়ায় নয়তো খুঁটির ফাঁকে অসম্ভব শক্তি নিয়ে লেপ্টে থাকে। গুঁতো মেরেও সরানো যায় না। অথবা কোথাও ঝুলতে থাকা কাপড়ের ফাঁকে চোখ পাকিয়ে চেয়ে থাকে।
অন্য কোনো কারণ না থাক শুধু বিরক্তিকর ডাকটির জন্য বাড়ি থেকে এদের তাড়িয়ে দেয়া যায়। বাবা বললেন : ‘থাক না, ঘরে তক্ষক থাকলে বজ্রপাত হয় না।’
ঘরে বজ্রপাত! শুনে বুকটা ধক করে উঠল। তাহলে কি আমাদের উপরে বিধাতার অভিশাপ আছে? শুনেছি এমন শাপ ভিন্ন ঘরে বজ্রপাত হয় না।
এছাড়াও ঘরের নেংটি ইঁদুর, মাকড়সা, তেলাপোকা, বিষাক্ত শতপদী, ছোট সাপ এসব ধরে খায়।
শুনে মনটা একটু স্বস্তি পেল। শতপদী প্রাণীটাকে আমি যমের চেয়েও বেশি ভয় পাই। যাক অন্তত এজন্য এদের ঘরে থাকার অনুমতি দেয়া যায়।
বছর ঘুরতেই তক্ষকগুলো কিছু বাচ্চার জন্ম দিল। যে যেদিকে ইচ্ছে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কাউকে কিছু বলি না। পরস্পর পরস্পরের দিকে নিমিলিত চোখে তাকিয়ে থাকি। শুধু যেখানে সেখানে বিষ্টা ত্যাগ করে ঘর নোংরা বানায় এই যা সমস্যা।
সুখস্বপ্নে বিভোর করে রাখা তক্ষকগুলো হয়ে গেল দুঃস্বপ্নবাহী প্রেত।
এর মধ্যে বড় সাইজের একটায় একটা কা- করে ফেলল। ঘরের বেড়ায় ঘুরে বেড়াতে দেখে আমার মেয়েটা ধরতে গেলে আঙুলে কামড় দিয়ে একেবারে ঝুলে রইল। তার মা কান্নারত মেয়েটার হাতে ফুটখানেক লম্বা একটা টিকটিকি সদৃশ বিচিত্র বর্ণের প্রাণী ঝুলছে দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আমি দৌড়ে এসে টেনে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম। টান দিলে, তক্ষকটি আরও জোরে কামড় বসায়। মেয়েটির কান্নার চিৎকারও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। শুনেছি কচ্ছপ আর তক্ষকের কামড় নাকি এত শক্ত যে, বজ্রপাত না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ে না। এখন তো শীতকাল, তাহলে বজ্রপাতের জন্য আরও চার-পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে? মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
আমার অবস্থা দেখে বাবা দৌড়ে এলেন। বেকুব, গাধা ইত্যাদি গালাগাল করতে করতে আমাকে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিলেন। হয়তো দু’একটা চড় থাপ্পড়ও লাগিয়ে দিতেন কিন্তু অতকিছু করার সময় নেই বলে বেঁচে গেলাম। তক্ষকটিকে চেপে ধরতে বলে যথাশক্তি প্রয়োগে প্রাণীটার চোয়ালের উপর-নিচ পাটি বিপরীত দিকে টেনে ধরলেন। তক্ষকের চোয়াল শক্ত হতে পারে কিন্তু মানুষের শক্তি তো সে আর ধরে না। তক্ষকের মুখটা খুলে গেল। মেয়ের আঙুল ছাড়া পেল।
মেয়ে আতঙ্কিত। রক্ত দেখে ভয়ে চিৎকার করছে। তার মা সম্বিত ফিরে পেয়ে মাতৃস্নেহ প্রদর্শেনের জন্য মেয়ের হাতের বাহুতে বাঁধ দিতে গেল। ‘তক্ষকের কামড় মারাত্মক বিষাক্ত’ এই ভুল তথ্য জেনে ভ্রান্তজ্ঞানে বড় হওয়াদের মধ্যে সেও একজন। বাবা বললেন, ‘বাঁধার দরকার নেই। আমি কয়েক বার তক্ষকের কামড় খেয়েছি।’
এই অঘটনের পর তক্ষকগুলো কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। এমনকি সময় নেই অসময় নেই তাদের সেই নিত্য পরিচিত ডাকও শোনা গেল না। যেন যুদ্ধের মাঠে ডিফেন্স মুডে চলে গেছে। একেবারে চুপচাপ। তারা হয়তো বুঝতে পেরেছে, আশ্রয় দাতার সাথে একটা বড়সড় অপরাধ করে ফেলেছে। এখন আর মুখ দেখাবার জো নেই। অথবা এমনও হতে পারে তারা হয়তো ভাবছে যে, একটা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় বাড়ির কর্তা মহোদয় আবার ‘অচিরেই যেন তক্ষকগুলোকে বাড়ি থেকে বিতাড়ন করা হয়’ বউয়ের দ্বারা এমন একটা চাপে পড়ে গেল। সুতরাং পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দেখা না দেওয়াই ভালো।
এক সন্ধ্যায় আবার হঠাৎ কয়েকটা একসাথে ডেকে উঠল। আমার বউ রান্না ঘর থেকে দৌড়ে এল।
‘ওই ওই তোমার তক্ষকগুলো ডাকছে আর তুমি এদের খুঁজে পাও না।’ মোক্ষম অভিযোগ।
প্রাণীগুলোকে কেন দেখা যায় না আর তারা কেন ডেকে নিজের অস্তিত্ব ফাঁস করে না, যেন সব দোষ আমার। আর কথারও কী শ্রী! ‘তোমার তক্ষক!’ ভাবটা যেন এমন আমিই প্রাণীগুলোকে আদর করে লালন-পালান করছি। সে-কারণে সামলানোর দায়িত্বও আমার। যা হোক, বউয়ের ঝামটা খেয়ে টর্চের আলো ফেলে তক্ষক খোঁজা শুরু করলাম। খুঁজে পেলাম না। কোথায় কোন চিপায় লুকিয়ে আছে কে জানে।
বর্ণিল কিন্তু ভয় উদ্রেককারী একটা প্রাণীকে নিয়ে আমার পরিবারে এই যে আলোড়ন; পক্ষ-বিপক্ষ, মান-অভিমান, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি; পরিবেশটা হঠাৎ অন্য আরেকটা দিকে মোড় নিল।
ঘটনার মাস খানেক পর। বাজারে কিছু শুকনো হলুদ আর দুটো কলার ছরা বিক্রি শেষে বসে আছি। হাতে টাকা এলে প্রয়োজন না থাকলেও এটা ওটা কেনার ইচ্ছেগুলো মনের কোণে এসে সুড়সুড়ি লাগায়। ভাবছিলাম চায়ের দোকানে ঢুকব, নাকি বাড়ির জন্য মাছ-গোস্ত নিয়ে যাব। ভাবনার শেষ হলো না। উতঙ্ক মুনি এসে জোর করে টেনে চায়ের দোকানে ঢুকাল।
একটু অবাক হলাম। সম্পর্কে সে আমার বউয়ের দিকে তালতো ভাই। আপন নয়, লতানো প্যাঁচানো। চাকমা কুটুম অর্থাৎ গুরুত্বহীন সম্পর্ক। ভাবলে আপন নয়তো বহুদূর। এর আগে তার সাথে দেখা হলে, ‘তালতো কেমন আছ?’ ‘ভালো আছি।’ প্রত্যেকে একটি করে বাক্য বিনিময় আর একটু হাসি বিনিময় ছাড়া সম্পর্কের গভীরতা কখনও এর বেশি এগোয় নি। হয়তো সে পাশ কেটে গেছে নয়তো আমি। দুজনের কোথাও যে দেখা হয়েছিল একথা মনে রাখার আর কোনো প্রয়োজন কেউ বোধ করি নি।
উতঙ্ক মুনি গরম গরম পরোটা আর জিলেপির অর্ডার দিল। জিলেপির গায়ে পরোটা মুড়িয়ে রোল করতে করতে সে বলা শুরু করল। প্রথমে এদিক ওদিক একবার দেখে নিল। তার এমন ভাব দেখে আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। এমনকি কথা সে আমাকে গোপনে বলতে চায়? শুনেছি সে নাকি ১ নম্বর পার্টির হয়ে কাজ করে। আমি রাজনীতির অ আ না বুঝা সাধারণ পাবলিক। ১ নম্বরেও নেই, ২ নম্বরেও নেই।
সে গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘তালতো তোমার ঘরে নাকি বেশ বড় বড় তক্ষক আছে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ আছে তো।’
‘কত বড়?’
আমি তাকে আনুমানিক একটা সাইজ দেখালাম কত বড় হতে পারে। তার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। জানতে চাইল, ‘হাঁসের পা নাকি মুরগির পা?’ বিষয়টা বুঝি নি দেখে সে খোলাসা করল, তক্ষকের পায়ের আঙুলগুলো যদি মুরগির আঙুলের মতো পৃথক করা থাকে তাহলে মুরগির পা আর হাঁসের পায়ের মতো জোড়া অবস্থা হলে হাঁসের পা। হাঁসের পা হলে দাম বেশি, কোটি টাকার মামলা। মুরগির পা হলেও সমস্যা নেই, সাইজ বড় হলে অন্তত লাখ দশেক তো পাওয়া যাবেই।
শুনে আমার বুক কেঁপে উঠল। এবার বুঝি কপাল খুলল। এ তো গুপ্তধন। আর আমি কিনা তাকে ঘরছাড়া করতে চাইছি! গরম পরোটা আর জিলেপি ভালো লাগা সত্ত্বেও ইচ্ছে করছিল তখনি এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখার, তক্ষকগুলো হাঁসের পা নাকি মুরগির পা।
মনে পড়ল ইদানীং আমার স্ত্রীর ধর্মের প্রতি অত্যধিক ঝুঁকে পড়া। কোথায় নতুন কেয়াঙ তৈরি হচ্ছে, কোথায় কোন ধুতাঙ্গ ভিক্ষুর আবির্ভব ঘটেছে, কোন কেয়াঙে কবে বুদ্ধমূর্তি উৎসর্গ করা হবে, কবে কোন কেয়াঙে পালা সোয়াইঙ খাওয়ানো হবে ইত্যাদি নিয়ে এখন সে রাত-দিন পড়ে থাকে। এটা ধর্ম-কর্মের ফল কিনা কে জানে!
উতঙ্ক মুনি আমাকে কয়েকটা কাজ দিল। হাঁসের পা নাকি মুরগির পা খোঁজ নেয়া, সম্ভব হলে ধরে ওজন মেপে দেখা আর মোবাইলে ছবি তুলে তাকে পাঠানো।
কথার ফাঁকে সে আমাকে কোটিপতি বানিয়ে ছেড়েছে। আমি তখন ক্ষণে ক্ষণে ভুলে যাচ্ছি কোথায় আছি। সর্বশেষ সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ জারি করল, ‘কথাটা যেন গোপন থাকে এবং কেউ তক্ষক দেখতে আসলে যেন না দেখাই।’
ঘরে পৌঁছাতেই যা দেরি, প্রথমে বউকে বললাম, তারপর বাবাকে। কোটি টাকার স্বপ্নে তারাও বিভোর। মুহূর্তে ঘরের পরিবেশকে একটা বিচিত্র অনুভূতির আবহ জড়িয়ে ধরল। একদিকে ধনী হওয়ার সুখ স্বপ্ন অন্যদিকে সব হারানোর ভয়।
উতঙ্ক মুনি বার বার নিষেধ করেছে, কথাটা যেন গোপন থাকে। কিন্তু গোপন রাখি কিভাবে? রাত নেই দিন নেই কপাল পোড়া তক্ষকগুলো ‘হক্কেঙ’ ‘হক্কেঙ’ শব্দে ডেকে ওঠে লোকজনের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। আগে এ ডাক শুনলে বিরক্ত লাগত। এখন লাগে ভয়। মনে হয়, এই বুঝি গুপ্তধন আছে খবর পেয়ে লোকজন ছুটে এসে সব কেড়ে নিল। এদিকে তক্ষকগুলোর মুখ বন্ধ রাখারও কোনো উপায় নেই। বুঝতে পারছি ধন থাকলেও জ¦ালা না থাকলেও জ¦ালা।
সুখস্বপ্ন বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সুখের স্থান কেড়ে নিল ঈর্ষা আর শত্রুতামি। গ্রামে মধুমঙ্গলের সাথে আমার কখনও সদভাব ছিল না। সে চায় না যে আমি ভালো থাকি। হয়তো এজন্য যে, তার কৈশোর কালে একবার মদ খেয়ে মাতলামি করার কারণে আমি তাকে থাপ্পড় দিয়েছিলাম, সেটি কখনও সে ভুলতে পারে না। ঘটনাটা মনে করে করে সে আমার উপর আক্রোশ মেটাতে চায়।
এখন মধুমঙ্গল ২ নম্বর পার্টির এলাকার নেতা।
এক রাতে সে তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে আমার ঘরে এল। মুখে হাসির রেখা তুলে বলল, ‘ভাইজান, তোমার বাসায় এক ছিলিম তামাক খেতে আসলাম। মেহমান এসেছে, ভাবিকে বলেন না হুক্কাটা নিয়ে আসতে।”
তার মুখের হাসি আর কথার ভঙ্গিতে সম্প্রীতির কোনো চিহ্ন নেই, আছে অর্ডার অর্ডার ভাব। রাত বিরাতে শুধু এক ছিলিম তামাক খাওয়ার জন্য দলবেঁধে কারও বাড়িতে লোকজন আসে না সেটা পাগলও বুঝে। তার কথা আমলে না নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘরের ভিতরে গিয়ে হুক্কাটা সাজিয়ে নিয়ে এলাম।
দলের ভিতর থেকে পাতি গোছের একজন বলল, ‘ইদানীং ১ নম্বর লোকজনের সাথে ভাইজানের নাকি বেশ ভাবসাব। দোকানে দোকানে জিলাপি পরোটা খেতে দেখা যায়। প্রতিবেশী হিশেবে আমাদের চা-নাস্তা খাওয়ানোর দরকার নেই। এক ছিলিম তামাক হলেই চলবে।’
বুঝতে বাকি রইল না খোঁচাটা কোথায়। উতঙ্ক মুনির সাথে সাক্ষাতের বিষয়টা ওরা জেনে গেছে। বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, বিষয়টা রাজনৈতিক নয় ¯্রফে ব্যবসায়িক। লুকিয়ে লাভ নেই বুঝে। পুরোটা খুলে বললাম। শেষ পর্যন্ত তারা বুঝল। তবে বিচারক হিশেবে নয় ব্যবসায়ী হিশেবে।
ঘরের সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজে ঘরের মূল খুঁটিতে বেড়ার আড়ালে তক্ষকগুলো তারা খুঁজে পেল। এতগুলো মানুষ দেখে তক্ষকগুলো বোধহয় খুশি হয়েছে, আবার ডেকে উঠল। এবার তারা আমার ছিদ্র খোঁজা শুরু করল। কয়টা দোষ খুঁজে পেলে আমাকে তক্ষকের মালিকানা থেকে বাদ দেয়া যায় সেই চেষ্টায়। বুঝলাম তথাকথিত অপরাধের চাপে আমাকে চেপে মেরে তক্ষকগুলো হাতানোই তাদের উদ্দেশ্য।
পরদিন থেকেই তক্ষকগুলোর দেখাশোনার ভার মধুমঙ্গলরা নিয়ে নিল। সুখস্বপ্নে বিভোর করে রাখা তক্ষকগুলো হয়ে গেল দুঃস্বপ্নবাহী প্রেত।
এদিকে খবরটা উতঙ্ক মুনির কাছে পৌঁছাতে সময় লাগল না। সে বুঝে গেল তক্ষকগুলো বেহাত হয়ে গেছে। কোটি টাকার তক্ষকের আশা ছেড়ে দিয়ে সে আমাকে খবর পাঠাল অগ্রিম হিশেবে দেয়া ৩ লক্ষ টাকা যেন আমি সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিই।
কিভাবে ফেরত দিব? টাকা কি আর হাতে আছে? জমি বন্ধক রেখেছি, হালের গরু কিনেছি এক জোড়া, চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে বাবার মূত্রাশয়ের অপারেশন করিয়েছি, বাকি টাকা গেছে পরিবারে সবার পেটে।
উতঙ্ক মুনি টাকার জন্য তাগাদা দিচ্ছে শুনে মধুমঙ্গলরা এসে বলল, ‘একটা টাকাও ফেরত দেয়া যাবে না। ধরে নিতে হবে এ টাকাগুলো তারাই দিয়েছে। আমার দশা দেখে রাজা ত্রিশঙ্কু নিজেকে সৌভাগ্যবান ভেবে হাসতে লাগলেন।
দেখি, দেখি ঘরে নিয়ে যাই। বেশ ভালো সোয়াদ হবে বলেই মনে হচ্ছে।
টাকার জন্য উতঙ্ক মুনির তাগাদারও শেষ নেই। শুধু কি তাগাদা? বলে বেড়াচ্ছে টাকা না পেলে আমার স্ত্রী-সন্তান যাকে যেখানে পায় উঠিয়ে নিয়ে যাবে। টাকার উপর পার্টির রঙ ছিটিয়ে বলা শুরু করেছে টাকাগুলো তার নয় পার্টির সুতরাং সে যেমন মাফ করতে পারবে না তেমনি খেয়েও কেউ হজম করতে পারবে না।
গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে পারি না। বাজারে যাওয়া বন্ধ। ভয়ের কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে উতঙ্ক মুনি। দুদিন গেলে উপোস করতে হবে। নিরুপায় হয়ে হালের গরুসহ বউয়ের সোনাদানা যা ছিল বিক্রি করে উতঙ্ক মুনিকে লাখ খানেক টাকা ফেরত দিলাম।
টাকা দেয়ার খবরটা জানাজানি হতে বেশি দিন লাগল না। আবার মধুমঙ্গলরা এসে ধরল। তারা মানা করা সত্ত্বেও আমি কেন উতঙ্ক মুনিকে টাকা ফেরত দিলাম? আমি তাদের কথা শুনি নাই। যেহেতু তাদের কথায় চলি না, ১ নম্বরের কথায় চলি সুতরাং এ গ্রামে আর থাকতে পারব না। তাদের কথা অমান্য করে উতঙ্ক মুনিকে এক লাখ দিয়েছি তাদেরকে দিতে হবে দুই লাখ। আর গ্রামে থাকতে হলে দিতে হবে আরও দুই লাখ।
রাগে-দুঃখে চোখে জল এসে গেল। পৃথিবীর পানে চোখ তুলে তাকালাম। ভালো করে কিছু দেখি না। চারিদিকে কুয়াশা ভরা, ঝাপসা। বললাম, ‘এত টাকা কিভাবে দেবো? ভাই এক কাজ কর বরং আমাকে মেরে ফেল!’
মধুমঙ্গল বলল ২ নম্বর হলেও তারা এক কথার মানুষ। এটা ওটার ব্যতিক্রম হতে পারে কিন্তু তাদের কথার হয় না। একবার মুখ থেকে যা বের হয় তাই সত্য। গ্রামে থাকতে হলে টাকা দিতে হবে।
আমার আর কী করার আছে? সামনের দিনগুলো বিধাতার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমিও, আমার স্ত্রীর মতো তাকে ডাকা শুরু করলাম। রাখলেও তিনি মারলেও তিনি।
বর্ষার এক রাতে আগুন লেগে ঘরটা পুরে গেল। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, শর্ট সার্কিট হতে পারে না। রান্না শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে চুলোর আগুন চুলোয় নিভে যায়। চুলো থেকেও লাগার কথা নয়। বর্ষার রাত্রে তাহলে বজ্রপাতে আগুন লাগল নাকি? বজ্রপাতের আওয়াজ তো কেউ শুনে নি। এদিকে বুড়ো-বুড়িরা যে বলে তক্ষক থাকলে ঘরে বজ্রপাত হয় না। তাহলে তাদের কথা কি সত্য নয়?
পুড় যাওয়া ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার করতে গিয়ে ঘরের মূল খুঁটির একটা গর্তে তক্ষকগুলোকে পাওয়া গেল। আধপোড়া হয়ে মরে আছে। এত বড় বড় তক্ষক দেখে সবাই অবাক হলো। একজন বলল, ‘হায় ভগবান! এত এক একটা গুইসাপের সমান। পুড়ে একেবারে হয়েছেও তেমন। দেখি, দেখি ঘরে নিয়ে যাই। বেশ ভালো সোয়াদ হবে বলেই মনে হচ্ছে।’
তার কথাকে কেউ গুরুত্ব দিল না। যার ইচ্ছে সে নিয়ে যেতে পারে। এখন কাড়াকাড়ি করার কেউ নেই।