চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অন্তত দশ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। এ দশ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে থাকাকে রাজস্ব খাতে বড় ধরনের ধস হিসেবে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর সরকারি প্রচেষ্টার বিপরীতে লক্ষ্যমাত্রার অন্তত ২৩ ভাগ রাজস্ব আয় কমে যাওয়াও উদ্বেগজনক। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হলেও চট্টগ্রাম কাস্টমসে রাজস্ব আয় গত বছরের তুলনায় বহুলাংশে কমেছে। এজন্য কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পণ্য আমদানি কমে যাওয়া, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়ার ঘটনা রাজস্ব আয়ে ওই ধসের তৈরী করেছে। তবে অনেকেই মনে করেন, কাস্টমসের এক শ্রেণির দুর্র্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণেই রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে।
একাধিক সূত্র জানায়, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্ক থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমস প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫৭ হাজার ৪শ’৬২ কোটি টাকা। এ হিসেবকে সামনে রেখে অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪১ হাজার ৯শ’ ৫৭.২০ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৯ মাসে অর্জিত হয়েছে ৩২ হাজার ৪শ’ ১৯.০৮ কোটি টাকা। এসময়ের মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫শ’ ৩৮.১২ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ের পার্থক্য ২২.৭৩ ভাগ কম। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ৪৮ হাজার ৮শ’৬৫ কোটি টাকা, পরে সারাদেশের সব কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর স্টেশনগুলোর মতো চট্টগ্রাম কাস্টমসেও লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় ৪৪ হাজার ৬শ’৭৭ কোটি টাকা। অথচ গত অর্থবছরেও চট্টগ্রাম কাস্টমস লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪২ হাজার ৩শ’৪৪ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা থেকে রাজস্ব আয় কম হয় দুই হাজার ৩শ’৩৩ কোটি টাকা। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টমস ৩৬ হাজার ৬শ’৯০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছিল।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের আয় কমে যাওয়ার জন্য বিভিন্নমুখী কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কাস্টমসের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানি বৃদ্ধি, গাড়ি আমদানি হ্রাস, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি কমে যাওয়া ও শুল্ক কমে যাওয়া অন্যতম কারণ। তবে চট্টগ্রাম কাস্টমসের ঘুষ দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেক ব্যবসায়ী। মিথ্যে ঘোষণায় পণ্য আমদানি, ঘোষণার চেয়ে বেশি আমদানিসহ নানা জালিয়াতির কারণে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমে গেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র মিথ্যা ঘোষণা ঠেকালেও রাজস্ব আয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলেও একাধিক ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন।
আবুল খায়ের নামের একজন সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী বলেন, চট্টগ্রাম দিয়ে গাড়ি আমদানি অন্তত অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনুমানিক আট হাজার গাড়ি আমদানি হয়েছিল। চলতি বছরে সেখানে গাড়ি আমদানি হয়েছে চার হাজার তিনশটির মতো। এক বছরের ব্যবধানে গাড়ি আমদানি কমেছে ৩ হাজার ৬শ’৪৭টি। আর এতে রাজস্ব আয় কমেছে অন্তত ৩শ’৭৭ কোটি টাকা। গাড়ি আমদানি কমে গেলেও বেড়েছে গাড়ির পুরাতন ইঞ্জিন আমদানি। আর এই পুরাতন ইঞ্জিন আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। পুরাতন ইঞ্জিন আমদানির নানা পন্থায় শুল্ক ফাঁকির মহোৎসব চলছে। ফোর সিলিন্ডার ইঞ্জিন ঘোষণা দিয়ে এইট সিলিন্ডার এবং টেন সিলিন্ডারের ইঞ্জিন আনা হচ্ছে। এক একটি ইঞ্জিনে ট্যাঙ ফাঁকি দেয়া হচ্ছে গড়ে পঞ্চাশ হাজার টাকারও বেশি। নগরীর বিভিন্ন গুদামে কয়েক হাজার এইট সিলিন্ডার এবং টেন সিলিন্ডারের বড় ইঞ্জিন রয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরের নয় মাসেই চট্টগ্রাম কাস্টমস দিয়ে একটিও এইট কিংবা টেন সিলিন্ডার ইঞ্জিন আমদানির ঘোষণা দেয়া হয়নি।
চট্টগ্রামের গুটিকয়েক সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কয়েকজন পুরাতন ইঞ্জিন আমদানিকারক কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে। এমন বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদনও রয়েছে। এরপরেও বেপরোয়াভাবে বন্দর থেকে কন্টেনার খালাসের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। ওদিকে ওজনের উপর শুল্কায়ন হয় এমন বহু পণ্যের মিথ্যা ঘোষণা ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপান, হংকং, মালয়েশিয়া এবং দুবাই থেকে কন্টেনার বোঝাই করে গাড়ির স্পেয়ার পার্টস আমদানি করা হয়। এই পার্টস আমদানি নিষিদ্ধ হলেও শুধুমাত্র গ্যারেজ আছে এমন ব্যক্তিরা গাড়ির মেরামত কাজে ব্যবহার করার জন্য গাড়ির পুরাতন পার্টস আমদানি করা হয়। অথচ চট্টগ্রামে ইঞ্জিনের পার্টস আমদানিকারকদের কারোরই কোন গ্যারেজ নেই। বিভিন্ন গুদাম ও দোকানে এসব পার্টস বিক্রি করা হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে- পার্টসের পাশাপাশি কেবিনসহ নানা পণ্যে এক একটি কন্টেনারে কমপক্ষে ২৮ থেকে ৩০ টন বোঝাই করা হয়। অথচ খালাসের সময় ঘোষণা দেয়া হয় ১২ থেকে ১৫ টন। প্রতি কেজিতে আড়াই ডলার হারে টনে আড়াই হাজার ডলার শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এতে মিথ্যা ঘোষণায় ওজন কমিয়ে এক একটি কন্টেনারে গড়ে অন্তত ৩০ লাখ টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়।
দুবাই থেকে প্রতি সপ্তাহে তিন চার কন্টেনার পণ্য আনেন এমন বহু আমদানিকারক চট্টগ্রামে রয়েছেন। যাদের অনেকেই পুরাতন পার্টসের ভেতরে দুবাই থেকে সোনা এবং ডলার নিয়ে আসে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় কিছু ব্যবসায়ী এবং কাস্টমস কর্মকর্তারা আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। তবুও এদেরকে চিহিৃত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ভোজ্য তেল, চিনি, লোহা, স্ক্র্যাপ, ইঞ্জিন, পাথরসহ বিভিন্ন পণ্যের ওজন জালিয়াতির মাধ্যমেও শত শত কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আগের বছরের তুলনায় এবার চিনির ক্ষেত্রে শুল্ক আদায় কম হয়েছে ৩শ’২৭ কোটি টাকা। এমএস পাইপ ওয়েলডেড আমদানি কমেছে অন্তত ৩শ’ টন। ফলে রাজস্ব কমেছে ১০২ কোটি টাকা। ট্রান্সমিশন মডেম আমদানি কমেছে ৬০১ টন। এতে রাজস্ব কমেছে ২শ’৪১ কোটি টাকা। লেড অ্যাসিড আমদানি কমেছে ৫ হাজার ৩০৫ টন। ফলে রাজস্ব কমেছে ৮৬ কোটি টাকা। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমদানি কমলেও মিথ্যা ঘোষণা এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের নিয়ামক হয়ে উঠেছে। হিসাব থেকে হাজার হাজার টন পণ্য গায়েব করে শুল্ক ফাঁকি দিতে গিয়ে মোট আমদানির ‘ওজন’ কমে গেছে।
বন্দর ব্যবহারকারী কয়েকজন ব্যবসায়ী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মিথ্যা ঘোষণা একটি বড় সমস্যা। এমন সমস্যা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। তবে কাস্টমস কর্মকর্তা কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণেই মিথ্যা ঘোষণা টিকে আছে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের অগোচরে কিছু হচ্ছে এটা ভাবার কোন কারণ নেই। মিথ্যা ঘোষণা থেকে শুরু করে শুল্ক ফাঁকির যাবতীয় কার্যক্রমই কাস্টমস কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই করতে হয়। কাস্টমসের দুর্নীতি এবং অনিয়ম ঠেকানো গেলে রাজস্ব আয় কমতো। যেখানে দেশের সবকিছুতে ৭থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেখানে কাস্টমসের রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনা। সরকারের নীতিনির্ধারণী ফোরাম উপর্যুক্ত বিষয়ে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে চট্টগ্রামবাসী আশাবাদ ব্যক্ত করেন।