সামনে ঈদ। শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। ব্যাংকিং খাতে নানা হয়রানির অজুহাত। এজন্য সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হুন্ডি। চট্টগ্রাম শহরে কমপক্ষে ১০টি হুন্ডি সিন্ডিকেট রয়েছে। এদের সাথে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রেরও সম্পর্ক। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালান চক্রের এজেন্ট হিসেবে এখানে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট এ হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সবচেয়ে নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ ও তামাকুমন্ডি লেইনে অন্য ব্যবসার আড়ালে চুটিয়ে ওই হুন্ডি ব্যবসা চলছে। আবার স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালানের পাশাপাশি হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমেও দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে চট্টগ্রামের গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, শুধু রমজানেই নয়, সারা বছরেই হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসীদের টাকা দেশে আসছে। হুন্ডি প্রতিরোধে পুলিশ সবসময় সতর্কভাবে কাজ করছে।
একাধিক সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে হুন্ডির এজেন্টদের কাছে টাকা জমা দিয়ে দেশে তার নিকট আত্মীয়কে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর চট্টগ্রাম শহর থেকেই টাকার প্রাপককে হুন্ডির এজেন্ট ফোনে টাকার অংক জানিয়ে টাকা আসার বিষয়টি নিশ্চিত করে। পরে ওই টাকা ঠিকানা অনুযায়ী ঘন্টার মধ্যেই পৌছে দেয় হুন্ডির এজেন্টদের লোকজন। কোন ঝামেলা ছাড়াই এভাবে টাকা পেয়ে প্রবাসীর স্বজনরাও খুশি। আর এভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয় হুন্ডিতে। প্রবাসীদের বেশিরভাগই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এতে প্রবাসীদের অভিযোগ, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। কিন্তু হুন্ডিতে টাকা দেওয়ার ঘণ্টার মধ্যেই ঘরেই পৌঁছে যায়। এসকল প্রবাসীদের এমন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শহরে হুন্ডির অসংখ্য সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। শহরের রিয়াজুদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ ও তামাকুমন্ডি লেইনে অন্য ব্যবসার আড়ালে চুটিয়ে ওই হুন্ডি ব্যবসা চালাচ্ছে বহু ব্যবসায়ী। কিছু রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় অন্তত ১০টি সিন্ডিকেট হুন্ডির মাধ্যমে এভাবে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করছে। এ ব্যবসা করতে তারা কোন ঝামেলায়ও পড়তে হচ্ছেনা। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালান চক্রের এজেন্ট হিসেবে এসব সিন্ডিকেট দেশে বসেই হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রবাসীদের কাছ থেকে যে টাকা গ্রহণ করা হয়, সে টাকা দেশে আসে না। এখানকার এজেন্ট যারা স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত, তারাই প্রবাসী পরিবারে যে পরিমাণ টাকা পৌঁছে দেয়; সে পরিমাণ টাকা বিদেশে প্রবাসীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। এরপর ওই টাকার সমপরিমাণ স্বর্ণ চোরাইপথে দেশে আনা হয়। এভাবে বাংলাদেশে স্বর্ণ আসার পর সেই স্বর্ণের একটি অংশ আবার ভারতেও পাচার করা হয়। এরপর ওই স্বর্ণের টাকায় ভারত থেকে গরু নিয়ে আসে চোরাচালান চক্রের সদস্যরা। রমজানের ঈদ ও কোরবানির আগে হুন্ডির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টাকা আসে বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। আর এভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে ব্যবসা হওয়ায় রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। হুন্ডির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের রিয়াজুদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ ও তামাকুমন্ডি লেইনে অন্য ব্যবসার আড়ালে সরোয়ার, কালাম, সবুজ, হারিস, বাবলু, ইমরান, ফয়েজ, আকতার, আলম, সাইফুল, আজিজ ও বেলাল হুন্ডি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের ৩ মার্চ শহরের সিআরবি এলাকায় একটি প্রাইভেট কার থেকে ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের ১শ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে। এর মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জোরারগঞ্জে আরেকটি প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালিয়ে ২৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ৬শ’ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে পুলিশ। দুই ঘটনায় জড়িতরা রিমান্ডে এসব স্বর্ণ রিয়াজুদ্দিন বাজার থেকে পাচারের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল বলে স্বীকারও করে।
ওদিকে ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি রিয়াজুদ্দিন বাজারের বাহার মার্কেট থেকে সিন্দুকভর্তি ২শ’৫০ পিস স্বর্ণের বার ও নগদ ৬০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল সদরঘাট এলাকার একটি ইলেকট্রনিক্স পণ্যের গুদাম থেকে ২০ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রায় সবগুলো ঘটনায় রিয়াজুদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেইনের নাম উঠে আসে। এ ব্যাপারে রিয়াজুদ্দিন বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, অবৈধ কিছুর সাথে ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে আমাদের সমর্থন নেই। কারণ অবৈধ ব্যবসায়ীদের কারণে বৈধ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কোনো অবৈধ ব্যবসার সাথে আমাদের সমিতির সদস্যরা জড়িত নন। হুন্ডির মতো কোনো অবৈধ ব্যবসাকে আমরা সমর্থন করি না।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড চট্টগ্রামের জোনাল হেড জসিম উদ্দিন বাবুল সাংবাদিকদের বলেন, প্রবাসীদের আয়ের টাকা যেখানে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতো, সেখানে হুন্ডির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসার মধ্য দিয়ে ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সরকারও রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। অপরদিকে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মিজানুর রহমান বলেন, শুধু রমজান কিংবা ঈদকে সামনে রেখে নয়, পুরো বছরই এখানে হুন্ডি ব্যবসা চলে। হুন্ডি প্রতিরোধে আমরা সর্বদা আন্তরিক। এজন্য শহরের চারদিকে আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কাজ করছে।