আয়ের লক্ষ্য পূরণে যেমন পিছিয়ে, তেমনি উন্নয়ন ব্যয়েও। প্রত্যাশিত অগ্রগতির জন্য যেসব মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল চলতি বছরের বাজেটে, সেগুলোর দু-একটি ছাড়া বাকিগুলোর কাক্সিক্ষত অগ্রগতি নেই। ব্যাংকিং খাতে ‘লুটপাট’ আর ‘ডাকাতি কারবারে’ সামনের দিনগুলোয় বড় ধরনের আর্থিক সংকটের শঙ্কায় বোদ্ধামহল। এই পরিস্থিতিতে নতুন অর্থমন্ত্রী তার ধকল কাটাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা নিয়ে কৌতূহলের কমতি নেই।
কেউ বলছেন, নতুন অর্থবছর, নতুন অর্থমন্ত্রী, জঞ্জাল কিন্তু পুরনো। এটা মোকাবিলা করা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেই লক্ষ্যে তিনি কিছু পদক্ষেপের ইতিবাচক ‘মুডে’ আছেন এমনটি বোঝা যায় তার বাজেট বক্তৃতার শিরোনামে। ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ এই স্লোগানকে সামনে রেখেই তিনি এগুচ্ছেন। যদিও তিনি শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ, তবু বলছেন তার বাজেট হবে স্মার্ট বাজেট। সঙ্গতকারণেই কৌতূহলীদের প্রশ্ন কী থাকছে স্মার্ট বাজেটে? যা আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজেও একজন ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা। এখন তিনি নীতিনির্ধারকের আসনে। দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে শিল্প-বাণিজ্যবান্ধব একটি বাজেটই তার কাছে প্রত্যাশা। উদ্যোক্তার কষ্ট তিনি বোঝেন। উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে আয়ও করতে হবে। বসাতে হবে কর। সেই কর কতটা জনবান্ধব, নাকি গোষ্ঠীবান্ধব হবে সেটিও জানা যাবে আজকের বাজেট বক্তৃতায়।
ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন করে করারোপ হবে না। বাড়বে না করের হার। তাহলে প্রশ্ন- বাড়তি ব্যয় মেটাবেন কীভাবে? এ ক্ষেত্রে তিনি কি ‘এসআরও’ জারি করবেন? ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার ঘোষণা দেবেন। কিছুটা অনুদান নেওয়ার আশাও থাকবে। অনুদান নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া তার ইচ্ছের ওপর নির্ভরশীল। তাতে সমস্যা সরকার যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, বেসরকারি খাতে তখন পর্যাপ্ত ঋণ জোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যা বেসরকারি বিনিয়োগ তথা শিল্প-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। সরকার ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়।
এরই মধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ঘোষিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না। যদিও মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় এ সীমা বাড়ানোর দাবি ছিল। গত ৪ বছর ধরে এ সীমা একই জায়গায় রয়েছে। কমছে না কর্পোরেট করহার। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব আসছে বাজেট ঘোষণায়। আশার কথা যে, শেয়ারবাজারে মুনাফার ওপর করমুক্ত আয়সীমা দ্বিগুণ হচ্ছে। আবাসন খাতে নিবন্ধন ব্যয় কমছে। বাড়বে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের খরচ। মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিক্রীত সিমের পরিমাণ এখন ষোল কোটির মতো। এগুলোতে ব্যবহূত ইন্টারনেটের খরচ বাড়ানোর ঘোষণা থাকছে নতুন বাজেটে। উেস আয়কর কর্তনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আদায় বাড়াতে কঠোর পদক্ষেপ থাকছে। লোকসানি প্রতিষ্ঠান হলেও উেস আয়কর দিতে হবে। রপ্তানি খাতে উেস করের হার বাড়ছে চারগুণ। যা বাজেট ঘোষণায় না থাকলেও জুন শেষে স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এখন আদেশবলে এটি দশমিক ২৫ শতাংশ রয়েছে। যা ১ শতাংশে উন্নীত হবে।
অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের বিদ্যমান সুযোগ থাকছে। তবে আরো কিছু ছাড় ক্ষেত্র ভেদে হতে পারে। যা অর্থমন্ত্রীর আজকের ঘোষণায় স্পষ্ট হবে। বহুল আলোচিত সংশোধিত ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে। এটি স্তরভিত্তিক হওয়ায় কিছু পণ্যে ভ্যাট হার বাড়বে। তবে বিশেষ কিছু পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে স্পেসিফিক ভ্যাট নাম দিয়ে নমনীয় হারে ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা থাকছে। দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় সম্পূরক শুল্ক অন্যতম হাতিয়ার। আমদানিকারকদের দাবি থাকলেও তাতে নজর দেননি অর্থমন্ত্রী। রাজস্ব আওতা বৃদ্ধি এবং কর ফাঁকি রোধে অনলাইনে ভ্যাট আদায়ের অবকাঠামো তৈরি করা, ইসিআর মেশিন আরো বেশি কার্যকর করাসহ নানা পরিকল্পনার কথা বলবেন অর্থমন্ত্রী।
নতুন বাজেটের আকার
এদিকে এবারের বাজেট বক্তব্যের আকার আর গতানুগতিক থাকছে না। কমিয়ে আনা হয়েছে বাজেট বক্তৃতার আকার। নতুন বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। চলতি বাজেটের আকার ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশের বেশি। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা বেশি।
আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৮.২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ৮.১৩ শতাংশ অর্জিত হবে বলে ইতোমধ্যে খসড়া হিসাব করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এ ছাড়া নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৫.৫ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা থাকছে।
বাজেটে যেসব খাতে সংস্কারের প্রস্তাব করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ব্যাংকিং খাত, পুঁজিবাজার, সঞ্চয়পত্র ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ থাকছে। এ ছাড়া প্রথমবারের মতো উদ্যোগ থাকবে বেকারদের ‘স্ট্যার্ট আপ ফান্ড’ নামে একটি তহবিলের। ১০০ কোটি টাকার এ তহবিল থেকে স্বল্পসুদে সহজশর্তে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন নতুন উদ্যোক্তারা। এর বাইরে নতুন উদ্যোগের মধ্যে থাকছে প্রবাসীদের জন্য বীমা সুবিধা।
রাজস্ব আদায়
বাজেটে বড় আকারের ব্যয় মেটাতে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাকিটা এনবিআর বহির্ভূত উৎস থেকে আদায় করার লক্ষ্য থাকছে। সবমিলিয়ে অনুদানসহ আয় হবে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১৩ দশমিক ১ শতাংশের সমান।
সামগ্রিক ঘাটতি
আগামী অর্থবছরের বাজেট সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ (অনুদানসহ) দাঁড়াবে ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া এ ঘাটতির পরিমাণ হবে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। তবে অন্য বছরের মতো জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই রাখা হয়েছে ঘাটতির আকার। এই ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য রয়েছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হবে ২৭ হাজার কোটি টাকা।
আশাবাদ
অর্থমন্ত্রীর আশাবাদ, তার প্রথম বাজেট হবে ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার। শুধু এক বছরের জন্য নয়, সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে বিশেষ করে ২০৪১ সালকে টার্গেট করে তৈরি করা হয়েছে এবারের বাজেট। সেটি কতোটা বাস্তবায়নযোগ্য হবে সেটি দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরেকটি বছর।