কৃষক, মজুর, শ্রমিক যাদের নিরলস পরিশ্রম বাংলাদেশ উন্নয়ন মাপকাঠি ছুঁয়েছে, তাদের মধ্যে দেশের কৃষকরা সব থেকে অবহেলিত। কৃষকের উৎপদিত ধানের নায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষি শ্রমিকের গত কয়েক বছর থেকে থেকে কৃষকের ধান কাঁটতে চায় না শ্রমিকেরা। কোন কোন সময় কাটলেও পারশ্রমিক এত বেশী যে তা পরিশোধ করতে কৃষককে যথেষ্ঠ বেগ পেতে হয়। দিন মিজুর নিজেদের শ্রমের মুল্য নির্ধারণ করে। শ্রমিকেরা পারিশ্রম মজুরী বাড়াতে আন্দলোন করতে পারে। কিন্তু কৃষক বছরের পর বছর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতের কষ্ট মাথায় নিয়ে যারা দেশবাসির জন্য খাদ্য উৎপাদন করে, দেশকে খাদ্যপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে যাচ্ছে, আজ তারাই বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত। তারা কোন প্রতিবাদ করতে পারে না আন্দোলন করতে পারেনা। এবারই প্রথম দেখা গেছে কৃষকেরা প্রতিবাদ করেছেন, ধানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন, প্রেস ক্লাব, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে ধান ছিটিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। ইউএনও, ডিসি, পুলিশ, শিক্ষার্থী ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পেশার কৃষকদের ধান কেটে দিয়েছেন। কৃষকদের বাড়ী, বাড়ী গিয়ে ধান ক্রয় করেছেন এগুলি ছিল মূলত ফেসবুক, পত্র পত্রিকা ও টিভির শিরোনাম হওয়ার জন্য কৃষকদের মূলত কোন কাজে আসে নি। পত্র পত্রিকার প্রকাশিত প্রকাশিত রির্পোটে দেখা যায় খাদ্য গুদাম গুলি ধান দিয়ে ভর্তি করেছেন প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, নামধারি সাংবাদিক, শিক্ষক, অসৎ রাজনীতিবিদসহ আরও অনেকে। যা প্রকৃত তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবেই।
চাষীদের বোরো ধান উৎপাদন খরচ নিয়ে আলোচনার আগে কিছু কথা যে না বললেই নয়, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে মূল অর্থকরি ফসল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল পাট, আঁখ, তুলা এবং ধান। লাভের পরিমান উৎপাদন খরচ ও বাজার না থাকায় পাট চাষ প্রায় বন্ধ যা চাাষ হয় সেগুলির বেশীরভাগই শাক হিসেবে মানুষ খেয়ে ফেলেন। ভাল দেশি তুলার চেয়ে টেক্সটাইল মার্কেটে কম দামে নিম্নমানের বিদেশি তুলায় আগ্রহ অসীম। তাই তুলা চাষ বাজার হারাতে হারাতে বিলীন হয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিনি আমদানির কারণে আঁখ চাষে আর কোন লাভ আসে না। আমদানির কারণে দেশি চিনি শিল্প এখন লোকসানি খাতে পরিণত হয়েছে। ধান চাষে কৃষকরা যে লোকসানে পড়ছে তা এখন পত্র পত্রিকা, টিভি চ্যালেনগুলি খুললে দেখা যায়।
বোরো ধানের পেছনে কৃষকের শ্রম ও অর্থ ব্যয় বছরে সব থেকে বেশি হয়। চাহিদা বেশি থাকার কারণে এই ধানের উপর লাখ লাখ কৃষকের বছরের আয় নির্ভর করতো। ফলন ভাল কিন্তু সময় শ্রম ও ব্যয় বেশি বলে মহাজনরা এই ফসলে ভাগ কম নেয়। আর কোথায় কি রকম জানি না, তবে আমাদের উত্তরাঞ্চলে প্রায় হালকা চুক্তিতে কৃষকের কাছে জমি ছেড়ে দেন মহাজনেরা। অথচ বোরো ঘরে তুলে মহাজনের ভাগ পরিশোধ করার পর খুব একটা টাকা থাকে না বলে পরবর্তি ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যয় করতে পারে না। মোটা চাল আমদানির কারণে গত সাত আট বছর থেকে বোরো ধান পর্যাপ্ত দাম পাচ্ছে না কৃষকরা।
ধান লাগালেই ধান হয় না। এর পেছনে অনেক পরিশ্রম ও খরচ আছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও দেশের সিংহভাগ মানুষের ধারনা নেই ধান উৎপাদনে মাঠ পর্যায় প্রকৃত খরচ কত। দেশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিকে কৃষক ও কৃষি বিষয়ে বিরক্ত প্রকাাশ করতে দেখেছি। তারা হয়তো মনে করেন, চাষারা কারণ ছাড়াই অহেতুক হাঙ্গামা করছে। দেশে সব মাঠে পর্যাপ্ত ধানের উৎপাদন হয়, তারপরও কেন এরা অভাব অভাব করে, এরা আর কি চায়, এদের কারণেই হয়তো চালের দাম বাড়ছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের ধারনা সম্পুর্ণ ভুল। তারা যে চাল খায় সেটা চিকন চাল। বাজারে যেটার দাম আগাগোড়াই বেশি। দাম বেশি হবার কারণ হচ্ছে, দেশের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এসব ধানের আবাদ হয়, অন্য কোথাও হয় না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় চিকন ধানের দামটাও সব সময় বেশি থাকে। সামর্থেও অভাবের কারণে চিকন চাল সবাই কিনতে পারেনা। যারা এই চাল কিনতে পারেনা তাদের সংখ্যা এদেশে সবচেয়ে বেশি, বলা যায় দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ। সে সব মানুষের খাদ্য হচ্ছে মোটা চাল। যা বোরো ধান থেকে সংগ্রহ করা হয়। নিম্ন আয়ের মানুষের পেটের ক্ষুধা মেটায় কম দামের মোটা চাল, বোরো ধানের চাল। বোরো ধানের দাম কম কিন্তু তা উৎপাদন খরচ সামলাতে হিমসিম খেতে হয় মাঠ পর্যায়ের চাষীদের।
প্রশ্ন আসতে পারে, এই ধান উৎপাদনে আসলে কত খরচ হয়? হিসাবটা জানলে, অনেকেই বুঝতে পারবেন, কেন কৃষকরা ধান চাষে প্রতিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? বোরো ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে?
বাংলা বছরের মাঘ মাসের পহেলা তারিখ থেকে তিরিশ তারিখের মধ্যে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করে বিজ ছিটাতে হয়। বিঘা প্রতি বীজ লাগে ৩০০টাকা থেকে ৩৮০ টাকার। সুস্থ্য চারা তৈরি করতে তিরিশ দিন সময় লাগে। এ সময় পানি ও সার প্রয়োগে খরচ হয় বিঘা প্রতি আরো ১০০০ টাকা। এ ধানের জন্য জমি তৈরি করতে এক বিঘা জমিতে দরকার পাঁচশ কেজি গোবর সার, যার মুল্য ১২০০ টাকা। সার জমিতে আনা এবং ছিটানো বাবদ খরচ হয় ৫০০ টাকা। সার পচানোর জন্য জমিতে চাষ ও পানি দিতে হয়, সেখানে পানি ২০০ টাকা এবং পাওয়ারটিলারে চাষ খরচ ৫০০ টাকা। মাটি পাকাতে সময় লাগে সাত দিন। সাত দিন পর আবার চাষ ৫০০ পানি ২০০ টাকার দিতে হয়। তার দুই থেকে তিন দিন পরে রাসায়নিক সার পটাশ ১৫ কেজি ১৮০ টাকা, টিএসপি ১৫ কেজি ৩৬০ টাকা, ইউরিয়া ৫ কেজি ৮০ টাকা। এরপর সাত দিন অপেক্ষা। সাত দিন পর আবার পানি ২০০ টাকা চাষ বাবদ ৫০০ টাকা। বীজ তলা থেকে চারা এনে জমিতে রোপন করতে বিঘা প্রতি ১৬০০ টাকা শ্রমিক মজুরী দিতে হয়। পুরো ফসলের চাষে ন্যুনতম ১২ বার পানি সেচ দিতে প্রতিবার ৩০০ টাকা হিসেবে মোট ৩৬০০ টাকা খরচ হয়। আবহাওয়া প্রতিকূল হলে বৃষ্টির পানি এখানে খরচ কিছুটা কমিয়ে দেয়। ধান রোপনের দশম দিনে দশ কেজি ইউরিয়া ১৬০ টাকা, সাথে ঘাস মারার বিষ দেড় প্যাকেট বা দেড় কেজি ১২০ টাকা। পঁচিশ দিন পর নুন্যতম ৩০ কেজি ইউরিয়া সার ৪৮০ টাকা তার সাথে এক কেজির এক প্যাকেট সালফার ৪৮০ টাকা। এর সাত দিনের মধ্যে ৮০ লিটার পানির সাথে মাজরা পোকা মারা বিষ ১৫ গ্রাম, সাথে মেশাতে হবে পাতার পোকার বিষ- ১০০ মিলি, ছত্রাক নাশক ১০০ গ্রাম-মোট খরচ ৫৩০ টাকা। তার ১৫ দিনের মাথায় দানা বিষ প্রয়োগ করতে লাগে বিঘা প্রতি দুই কেজি হিসেবে ৩০০ টাকা। এর ঠিক ১৫ থেকে ২০ দিন পরে আবার মাজরা পোকা মারা বিষ ১৫ গ্রাম তার সাথে মেশাতে হবে পাতার পোকার বিষ ১০০ মিলি, ছত্রাক নাশক ১০০ গ্রাম যার খরচ ৫৩০ টাকা। ধানের শীষ বের হবার পূর্বে আবারও মাজরা পোকার বিষ ১৫ গ্রাম সাথে মেশাতে হবে পাতার পোকার বিষ ১০০ মিলি, ছত্রাক নাশক ১০০ গ্রাম মোট খরচ ৫৩০ টাকা। ধানের শীষ বের হয়ে, হেলে যাওয়ার আগে ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হয় ব্লাস্ট প্রতিষেধক জিল ১০০ গ্রাম, কার্বাডাজেম ১০০ গ্রাম সঙ্গে যে কোন গন্ধ যুক্ত তরল বিষ ১০০ মিলি, যাতে খরচ ৪২০ টাকা। শীষ হেলে যাওয়া থেকে পাক ধরার আগে আবারও মাঠে ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হয়। ব্লাস্ট প্রতিষেধক হিসেবে জিল ১০০ গ্রাম, কার্বাডাজেম ১০০ গ্রাম সঙ্গে যে কোন গন্ধ যুক্ত তরল বিষ ১০০ মিলি, যার খরচ ৪২০ টাকা। এরপর আসে ধান কেটে ঘরে তোলার পর্ব। ধান কাঁটা মাড়াই ৬০০০ টাকা বিঘা, স্থান বিশেষে খরচ বেড়ে যায়। উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় প্রতি বিঘায় ধান উৎপাদন হয় ২৫ থেকে ৩০ মন। ধানের নায্য মূল্য না পাওয়ায় প্রতিবছর কৃষককের ক্ষতি হচ্ছে। বোঝার উপর শাকের আঁটি বাড়তে বাড়তে নিজের জমি জায়গা বিক্রি করে দায় দেনা পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে তারা ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অনেকে বলছেন আর করবো না ধান চাষ দেখবো তোরা কি খাস? কিন্তু কৃষক কি সেটা পারবেন ?
চার থেকে পাঁচ মাস গাধার মত খেটে এক বিঘা জমির ফলন বিক্রি করে একজন কৃষক সর্বচ্চ ১৬ টাকা পায়। তাতে তারা নিজেদের খরচ এবং মহাজনের পাওনা শোধ করে, আবারও মাঠে পরবর্তী ফসল ফলাতে প্রস্তুতি নেয়। তবে নিজেদের জন্য কোন অর্থ সঞ্চয় করতে পারে না। মাসের হিসেবে এই টাকা খুবই সামান্য। জমি খাটিয়ে যেমন মহাজনেরা লাভ করতে পারে না, তেমন শরীর খাটিয়ে কৃষকরাও লাভ করতে পারছে না। পর্যাপ্ত অর্থ হাতে না থাকার ফলে সারাজীবন তাদের টানাটানি ও ধার দেনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বেশির ভাগ কৃষক দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পড়ে পড়ে সমস্ত লাভ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় প্রথম সপ্তাহে। তারপরও তারা আবার আশায় বুক বাঁধে। জমিতে হাল দেয় বাংলার সোনার কৃষক বাংলার মাটিতে সোনার ফসল ফলায়। ঝড় ঝঞ্ঝা শীলাবৃষ্টি জাতিয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলেও তাদের মনবল নষ্ট হয়না। তারা হচ্ছে সোনার বাংলার সত্যিকারের সোনার মানুষ, দেশের আসল নাগরিক। অথচ প্রতিবার লোকসানের বোঝা বইতে বইতে এখন ধান আবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে কৃষক।
এদিকে আমলারা অনেকটা না বুঝেই কারণটা রাইসমিল মালিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। চাপটা এমন লাভ করতে না পারলেও যেন জমি জায়গা বিক্রি করে তাদের ব্যবসা করতে হবে। অথচ আসল ঘটনা হচ্ছে অসময়ে দেশে মোটা চালের আমদানির অনুমোদন। সেই সময়ে দেশে পর্যাপ্ত ধানের ফলন থাকার পরও চাল আমদানি হচ্ছে। আমদানিকৃত চালের সাথে প্রতিযোগিতায় দেশীয় রাইসমিল মালিকরা মার খাচ্ছে। বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ তারা ধান কিনছে না। কিনলে সে ধান ছাঁটাই করে বাজারে বিক্রি করতে পারছে না। লাভ না করতে পারলে কেন তারা বাজারে নামবে, এতে করে বাড়ছে তাদের ঋণের বোঝা যা মিল বিক্রি করেও পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এই সুযোগে কিছু মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবসায়ী বা দালাল, সিন্ডিকেট, প্রভাবশালী অসৎ রাজনীতিবিদ, নেতা পাতিনেতা, শিক্ষক, কথিত সাংবাদিক সিন্ডিকেট তৈরী করে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলা খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করেছেন জাতীয় ও অলাইন পত্রিকায় নিউজ প্রকাশিত হয়েছে। (সূত্র ৯ জুন দৈনিক ইনকিলাব ও ৮ জুন দৈনিক যায়যায় দিন) শুধু ধানের সময় নয় গমের মৌসুমেও এ শক্তিশালী প্রভাবশালী সিন্ডিকেট নিন্মমানের গম আমদানি বা ক্রয় করে রাতারাতি রেলওয়েবাজার খাদ্যগুদাম ভর্তি করার ব্যপক অভিযোগ রয়েছে। তারা দিনে দিনে আঙুল ফুলে কলাগাছ তার পর বটবৃক্ষ হয়েছেন, অবৈধ টাকার পাহাড় গড়েছেন। ধরাকে সারা করছেন না।
হাট থেকে কম দামে ধান কিনে মজুদ করছে এবং খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের যোগসাজসে খাদ্য গুদাম গুলি ধান দিয়ে ভর্তি করেছেন এবং প্রকৃত কৃষকেরা ধান গুদামে বিক্রি করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পরে তারা বিভিন্ন রাইসমিলে ব্যবসায়ীক সুবিধা নিয়ে উচ্চমূল্যে সরবরাহ করছে। প্রভাবশালীদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে দালালরা ও সিন্ডিকেট সদস্যরা লাভবান হচ্ছে কিন্তু কৃষক ও মিলার দুপক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সরকারি হিসেবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হিসেব করলে দেখা যাবে কৃষককরা বছরে সমপরিমান টাকা লোকসানে আছে। প্রকৃতভাবে শুধু গোদাগাড়ী খাদ্য গুদামে ৪১০ মে. টন ধান খাদ্য নিয়ন্ত্রক কোন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান ক্রয় করেছেন এবং কার নামে চালান আছে কে কে কত লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন কার নামে কত খালি বস্তা বরাদ্ধ দিয়ে বিষয়গুলি তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলেই গোদাগাড়ীর সাধারণ কৃষকগণ হবেন। একজন সিন্ডিকেট সদস্য ৩০ থেকে ১০০ টন ধান দেয়ার প্রমান রয়েছে। এজন্য একজন সিন্ডিকেটের হোতার উদাহরণ তুলে ধরা হলো: গোদাগাড়ী পৌরসভা সদরের আফজি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের কারিগরি শাখার সহকারি শিক্ষক ও কথিত সাংবাদিক পরিচয়দানকারী শামসুজ্জোহা বাবু নিজেই প্রভাব খাটিয়ে সিন্ডিকেট তৈরী করে খাদ্যগুদামে ধান সরবরাহ করছে।
গত রবিবার (২ জুন ) অভিযোগের অনুসন্ধান করতে গিয়ে সত্যতাও মিলে যায়। দামধারী শিক্ষক ও সাংবাদিক আগেই খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ৪০ টন ধান বিক্রয় করেছে। আবারও প্রায় ৩০ টন ধান দেবার জন্য গুদামের ভেতরে স্তুপ করে ঢেকে রাখা হয়েছে আছে কয়েকটি ধান বোঝায় টলিও। গুদামে ঢুকা মাত্রই সেটাও চোখে পড়লো। এছড়া রেলবাজার এলাকার এক প্রভাবশালী মেল মালিক ধান সিন্ডিকেটের হোতা দিয়েছেন শতাধিক মেট্রিক টন ধান বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। মাদ্রসার জৈনক শিক্ষক ও কথিত ঠিকাদার ৪০ টন ধান সিন্ডিকেট তৈরী করে দিয়েছেন বলে প্রমান রয়েছে। ধান চাষ করেন না এমন কিছু প্রভাবশালী দলের লোক অবাধে খাদ্য গুদামে ধান দিলেও প্রকৃত সাধারণ কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন।
ওই সময় কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা হলে তারা অভিযোগ করেন, ধান ক্রয় করা হবে প্রকৃত কৃষকদের কাছে হতে এই মাইকিং শুনে গুদামের কর্মকর্তার সাথে ধান দেবার কথা বলতে আসলে সাফ জানিয়ে দেয় গোদাগাড়ী পৌরসভার বরাদ্দকৃত ধান ক্রয় করা হয়ে গেছে আর কোন সুযোগ নেই
এসব অভিযোগে বিষয়ে খাদ্য গুদামের পরিদর্শক (ওসি এলএসডি) মির্জা জাকারিয়া বলেন, খাদ্য গুদামে উপজেলায় ৪১০ মেট্টিক টন কৃষকদের কাছ হতে ধান ক্রয়ের সুযোগ আছে এবং তা কৃষকদের কাছ হতেই কেনা হয়েছে বলে জানান। ধান ক্রয় যদি বন্ধই থাকে তাহলে খাদ্য গুদামের ভেতরে বিশাল ধানের বস্তার স্তুপ কেন রাখা হয়েছে কে রেখেছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন কে বা কারা রেখেছে তা কিছুই জানেন বলে সাফ জানান। ধান সিন্ডিকেটের হোতা কথিত শিক্ষক ও সাংবাদিক শামসুজ্জোহা বাবুকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন বললে অভিযোগ থাকলেও তিনি এসব কিছুই জানেন না বলে জানান। অথচ সহকারি খাদ্য পরিদর্শক মোঃ সোহেলের কাছে হতে কৃষকদের বস্তা দেবার খাতা দেখতে চাইলে ২৬-৫-২০১৯ তারিখে তার নামে ২২৫ টি বস্তা, ২৭-৫-২০১৯ তারিখে তিন দফায় ৭৫ টি করে ২২৫ টি বস্তা, পুনারয় ২৮-৫-২০১৯ তারিখে ২২৫টি, ৩০-৫-২০১৯ তারিখে দুই দাফায় ২২৫টি ও ৭টি বস্তা দেবার রেকর্ড করা আছে। শুধু বাবুই নয় কৃষক সেজে সিন্ডিকেট তৈরী করে খাদ্য ধান দিয়েছেন অনেকে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ৩১-০৫-২০১৯ ইং তারিখে মেহেদী ৩০০ বস্তা, নূর হোসেন ২২৫ বস্তা, মাসুদ ১০০ বস্তা, ২৮/০৫/১৯ ইং হাবিবুর ৭৫ বস্তা, বাবু ২২৫ বস্তা, মোহম্মদ আলী ৭৫ বস্তা, ২২/০৫/১৯ তারিখে মনির ৪০০ বস্তা, মিল মালিক গেন্দু ১০০ বস্তা, ২৫/০৫/২০১৯ ইং মতি/গেন্দু ৩০০ বস্তা ধান দেয়ার চিত্র তুলে ধরা হলো। যারা ধান দিয়েছেন তারা কেউ কৃষক নয় বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। বিষয়টি সরজমিনে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নিকট দাবী জানান কৃষকগণ।
এসব বিষয়ে খাদ্য পরিদর্শক (ওসি এলএসডি) মির্জা জাকারিয়া বলেন, কৃষকদের সাথে এসে কেউ এমনটি চালাকি করে নিতে পারে সেটা আমি বলতে পারবো না। কৃষক নয় বা কোন সাংবাদিককে এমন সুযোগ দেবার প্রশ্ন আসে না। এছাড়াও আমি এখানে নতুন এসেছি পরবর্তিতে আরো সতর্কতার সহিত কৃষকদের কাছে হতেই ধান ক্রয় করবো বলে জানান। তিনি নিউজ না করার জন্য আনুরোধ করেন। এই বিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বিকাশ চন্দ্র বলেন, প্রকৃত কৃষক ছাড়া একক কোন ব্যক্তির ধান দেবার সুযোগ নাই। সাংবাদিক বাবুর নামে বস্তা বরাদ্দের বিষয়ে বলেন কারো নামে বস্তা দেবার সুযোগ নেই তবে খাতায় তার নাম কিভাবে এল সে বিষয়ে তার জানা নেই বলে মন্তব্য করেন। এই বিষয়ে শামসুজ্জোহা বাবুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অকপটেই তা স্বীকার করে বলেন, আমার একটু ভূল হয়ে গেছে একবার সংশোধনের সুযোগ দেন। খাদ্য গুদামে ধান দিয়ে কিছু টাকা লাভ হয়েছেও বলে জানান।
বাংলাদেশে যে কটা সুগার মিল রয়েছে সেগুলোর জমিগুলো দখলমুক্ত করে আঁখ চাষ করলে, দেশের চিনির চাহিদা মিটবে, চিনি কম দামে পাওয়া যাবে, আবার বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে। প্রয়োজন শুধু একটু আধুনিকায়নের। কিন্তু সেদিকে কি কারও নজর আছে? দেশের কিছুকিছু জায়গায় এখনও পাট চাষ হয়। তবে তা এনজিও সংস্থা গুলোর শোরুমের পণ্য তৈরির জন্য, এনজিও গুলোর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে। অতিরিক্ত প্রয়োজন মেটাতে তারা বিদেশ থেকে পাট আমদানি করছে। অথচ দেশের পাট গবেষণা চাষ বৃদ্ধির দিকে পাট কর্তৃপক্ষের কোন নজরদারি নেই। নানা সমস্যার কারণে পাট, আঁখ, ধান উৎপাদন এখন বহু সমস্যায় জর্জরিত। সার পানির খরচের চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে অসময়ে চাল আমদানি। ধান চাষও হয়তো পাট, আঁখ, তুলা চাষের মত লোকসানের কারণে কয়েক বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে। যেভাবে কৃষক ধান চাষে লোকসান দিচ্ছে, তাতে একসময় ধান চাষ ছেড়ে সবাই জমিতে আম, লিচু, কাঁঠাল গাছ লাগাতে শুরু করবে। উত্তরাঞ্চলের বহু জায়গায় স্থানীয়রা এখন তাই করছে। এই পরিস্থিতি থাকলে একটা সময় এমন আসবে, যখন দেশ খাদ্য সংকটে পড়বে। কারণ রপ্তানি করে বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের মত দেশে কোন কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। সময় থাকতে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহন করে হবে বর্তমান সরকারকে।