নতুন অর্থবছরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। তীর্থের কাকের মতো দীর্ঘ কষ্টের অপেক্ষার একদিন হয়তো অবসান হবে, এ আসায় আছেন শিক্ষকরা। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বাজেটে নতুন এমপিওভুক্তির বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু না থাকায় নন-এমপিও শিক্ষকরা বেতনের দাবিতে ঈদের দিনেও রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে, খোলা আকাশের নীচে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছিলো। তখন নন-এমপিওদের বারবার ওয়াদা দিয়েও এমপিওভুক্ত করা হয়নি। এই শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই একথা কোনোভাবেই মানা সম্ভব নয়।
গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে এক সম্পূরক প্রশ্নে সরকার দলীয় সাংসদ খন্দকার গোলাম ফারুক সাংসদদের সুপারিশের ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির প্রস্তাব করেন। তার জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ক্ষেত্রে নীতিমালার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে এবার অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে।
দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়া না-হওয়া অনেকটা রাজনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত থাকেন, ভালো ফল না করা সত্ত্বেও সেগুলো দ্রুত এমপিওভুক্ত হয়। আবার তদবিরের জোর না থাকায় ভালো ফল করেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারেনি। শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সংশ্লিষ্টদের নীতি বিরোধী, একপেশে ও বৈষম্যমূলক কোন কিছুই কাম্য নয়।
বর্তমানে সারা দেশে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। এগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন ৭৫ থেকে ৮০ হাজার। এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এসব শিক্ষকরা ন্যূনতম বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শিক্ষাদানের মতো মহৎ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য এমন পরিস্থিতি লজ্জাজনক, যা কোনোভাবেই হতে পারে না। শিক্ষকেরা না বাঁচলে দেশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষা, কোনোটিই রক্ষা করা যাবে না। শিক্ষকসমাজকে পিছনে রেখে রাষ্ট্র কখনোই এগিয়ে যেতে পারবে না। এতে রাষ্ট্রেরই ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতি থেকেও দেশকে রক্ষা করা এখনই জরুরি।
সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে খন্দকার গোলাম ফারুক সম্পূরক প্রশ্নে বলেন, তারা রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনের আগে এমপিওভুক্তির অঙ্গীকার ছিল। জনগণ সবকিছুর জন্য সাংসদদের কাছে আসেন। তিনি জানতে চান, শুধু নীতিমালা নয়, সাংসদদের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত করা হবে কি না?
জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার সরকার সবকিছুতে যোগ্যতার মাপকাঠিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। অতীতে দেখা গেছে, কীভাবে দলীয় বিবেচনাকে অপব্যবহার করে দেশে যোগ্যতাকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে, মানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, ন্যক্কারজনকভাবে সবক্ষেত্রে দলীয়করণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার জনগণের সরকার। জনগণের অধিকারের ব্যাপারে শেখ হাসিনার সরকার সচেতন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ক্ষেত্রে যোগ্যতাকে বড় মাপকাঠি ধরা হচ্ছে। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে যোগ্যতা শিথিল করারও ব্যবস্থা আছে। দুর্গম অঞ্চল, হাওর অঞ্চল, চরাঞ্চল, বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে শৈথিল্য দেখানোর সুযোগ নীতিমালায় নেই। নীতিমালার বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ আছে বলে তিনি মনে করেন না।’
বর্তমানে নন-এমপিও শিক্ষকরা ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। এর বাইরে এদেরও অসুখবিসুখ হয়, আছে আত্মীয়-স্বজনও। ভাবা যায়? তারা কেমন আছেন? কিভাবে চলছেন? ইতোপূর্বে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক সংবাদ মাধ্যমে বলেছিলেন, ছোট ইলিশের দাম করতে গেলে পাতিলওয়ালা ইলিশ বিক্রেতা ধমকের সুরে বলে, ‘এতো দরদাম না করে প্লাস্টিকের ইলিশ খুঁজুন’। নন এমপিওদের পরিবারে ছেলে-মেয়েদের জন্য মাছ, গরুর গোশতের বাজারÑ সেতো স্বপ্ন!
বরিশালের জল্লা ইউনিয়ন আইডিয়াল কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক অরুণ কুমার বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘গত ১৮ বছর ধরে আমি শিক্ষকতা করছি। টিউশনি করে চলতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করে শিক্ষকতা পেশায় এসে মানবেতর জীবন যাপন করছি। বিয়ে পর্যন্ত করতে পারিনি। বর্তমানে ছোট বোনের বিয়ের খরচ যোগাতে পারছি না। শিক্ষকতা পেশায় এসে কি তাহলে ভুল করেছি...?’
সম্প্রতি সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে সময়োপযুগী সাফল্যের বড় প্রমাণ জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণা ও ইতোপূর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভূক্তিকরণ। যুগান্তকারী, সাহসের, সাফল্যের স্বর্ণোজ্জল ইতিহাস ২০১৩ সনে একই সাথে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজকে সরকারি চাকুরী ‘সোনার হরিণ’ প্রদান। এসব শিক্ষকদের পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির বক্তব্য ‘এবার আগের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হবে,’ বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন এজন্য বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের যুগবিনাশী ও কালোত্তীর্ণ কবিতা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’র শেষ উক্তিই স্মরণীয় হয়ে থাকবে এসব শিক্ষক পরিবারে (শেখ হাসিনার স্মরণে), ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর’।