নদীর নাম নরসুন্দা। মানচিত্রে নদী থাকলেও বাস্তবে পুরোটা নেই। যেটুকু আছে সেটুকুর পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। নদীর মধ্যে কছুরীপণা ও আবর্জনা এবং ময়লা ফেলে একে ভাগারে পরিণত করছে । নদী খেকোরা নদীর তীর দখল করে স্থপনা বানিয়ে ফেলেছে। কিশোরগঞ্জবাসীর অনেক আশার একটি প্রকল্পের নাম ‘কিশোরগঞ্জ জেলার নরসুন্দা নদী পুনর্বাসন ও পৌরসভা–সংলগ্ন এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প’। মোট বরাদ্দ ছিল ১১০ কোটি টাকা। এই টাকায় নরসুন্দা নদীর ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে বড় ছিল হোসেনপুর উপজেলার কাউনা এলাকা থেকে সদর উপজেলার নীলগঞ্জ পর্যন্ত ও শহরের মনীপুর ঘাট থেকে যশোদল এলাকার সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত নদী খনন। অন্যান্য কাজের মধ্যে ছিল নদীর ওই এলাকায় তিনটি পুরোনো সেতুর সংস্কার, ছয়টি নতুন বড় সেতু ও চারটি নতুন পদচারী–সেতু নির্মাণ, নদীর পাড়ে ৬ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ২০ কিলোমিটার রাস্তা, ৮টি ঘাট ও দুটি বিনোদন পার্ক, একটি ওয়াচ টাওয়ার, মুক্তমঞ্চ, ফুটপাতের বিদ্যুতায়ন ও পথচারী শেড নির্মাণসহ নদীপাড়ের সৌন্দর্যবর্ধন।
২০১২ সালের ২২ নভেম্বর তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বৃহৎ এ প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেন। দরপত্রের কার্যাদেশ মোতাবেক, প্রকল্পের কাজের মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকেই ব্যাপক অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজের অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় জনসাধারণসহ বিভিন্ন সংগঠন এর বিরুদ্ধে জন্য সভা-সমাবেশসহ নানা ধরনের আন্দোলন শুরু করে।
আন্দোলনকারীদের ভাষ্যমতে, নরসুন্দা নদীর দুই পাড়ে সোয়া ছয় কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য বরাদ্দ ছিল সাড়ে ছয় কোটি টাকা। এই টাকায় নদীর উত্তর পাশে শহরের গাইটাল মরাখলা থেকে একরামপুর সেতু পর্যন্ত এবং দক্ষিণ পাশে বড় বাজার সেতু থেকে মরাখলা পর্যন্ত ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়। ওয়াকওয়ের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের শেষের দিকে। কাজ শুরুর কমবেশি তিন মাসের মাথায় তাতে ধস শুরু হয়। কাজ শেষ হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু যেসব এলাকা ধসে পড়ে, তা আর মেরামত করে দেওয়া হয়নি।
শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা শহরের হাসপাতাল বটতলা এলাকায় ওয়াকওয়ে ভেঙে কাত হয়ে আছে। সেখানে প্রায় ৩০০ গজ এলাকাজুড়ে ভাঙন চোখে পড়ে। আরও কয়েকটি এলাকায় ওয়াকওয়ের একই অবস্থা। বটতলা এলাকার ব্যবসায়ী আলী আজম বলেন, এখানে ওয়াকওয়ে নির্মাণের পরপরই ভাঙন দেখা দিয়েছিল। প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেছে, অথচ এই ভাঙন মেরামত করা হয়নি। এখানে পথচারীরা প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। নদীর তীরের বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম তুষার বলেন, কিছুদিন আগে একরাম ব্রীজ সংলগ্ন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী স্থাপনা তৈরী করেছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি । শুধু তাই নয় নদীর তীরের সর্বক্ষ্রেত্রেই দখল করে ইচ্ছে মত স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠেছে ভ্রাম্যমান দোকান পাটও। ওয়াকওয়ের মধ্যে দুর্বা ঘাষ হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ইট ভেঙ্গে যাচ্ছে নদীর পাড়।
উকিল পাড়া এলাকার আরমান চৌধুরী বলেন, আমি বোন নিয়ে ঘুরতে এসেছিলাম কয়েকদিন আগে মাদকসেবীদের একটি গ্রুপ আমার বোনকে দেখে বাজে মন্তব্য করে। এতে আমি প্রতিবাদ করতে গেলে আমাকে মারতে আসে ওরা। প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষন করছি এরকম ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কটিয়াদি উপজেলার করগাও ইউনিয়ন থেকে মুক্তমঞ্চ এবং ওয়াচটাওয়ার দেখতে আসা মো. মিজান বলেন, আমি গত রোববার গ্রাম থেকে ঘুরতে এসেছিলাম। কিন্তু ওয়াচটাওয়ার এর সামনে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই কে মারধর করে আমার মোবাইল ফোন এবং টাকা পয়সা নিয়ে গেছে।
নীলগঞ্জ থেকে ঘুরতে আসা ইমরান হোসেন বলেন, আমি রমজান মাসে দুপুর বেলা ঘুরতে আসলে ওয়াচটাওয়ার এর সামনের ব্রিজে আমার মোবাইল আর টাকা পয়সা রেখে দেয় কয়েকজন ছেলে। আমি বাধা দিলে আমাকে অস্ত্র দেখিয়ে মারধোর করে। শোলাকিয়া এলাকার সোহাগ বলেন, আমি বন্ধুদের নিয়ে প্রায় সময়ই ওয়াচ টাওয়ার মুক্তমঞ্চ এলাকায় বিনোদনের জন্য যাই। কিন্তু বেশীর ভাগ সময়ই দেখা যায় মাদকসেবীরা মাদক গ্রহণ করছে তাছাড়া লেকপাড়ের পাশের ঝোপঝাড়ের আড়ালে তরুন তরুনীদের অশ্লীলতায় মেতে উঠতে ও দেখা যায়। যার ফলে আমরা পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে একটু স্বস্তির জন্য যেতে সংকোচ বোধ করি।
মুক্তমঞ্চে ঘুরতে আসা নকীব বলেন, গুরুদয়াল কলেজের পাশের মুক্তমঞ্চ এবং ওয়াচ টাওয়ার এলাকাটি মাদকসেবীদের আখড়া ও সন্ধার পর তরুন তরুনীদের অবাধে মেলামেশা এবং ছিনতাইয়ের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সন্ধার পর মাদকসেবীরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তমঞ্চ এবং ওয়াচ টাওয়ার এর আশে পাশের বিভিন্ন জায়গায় বসে মাদক গ্রহণ করছে।
নরসুন্দার পুর্বের অবস্থা ফিরিয়ে এনে সুন্দর পরিবেশ ও নদীকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবী নদী তীরের বাসিন্দাদের।