দেশ থেকে মানব পাচার বন্ধে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিলেও তা বন্ধ হচ্ছে না। বরং দিন দিন তা চরম আকার ধারণ করছে। সাগরপথে প্রতিনিয়ত ইউরোপ ও মালয়েশিয়ায় মানব পাচার করা হচ্ছে। আর সাগর পথে ইউরোপ ও মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছে। পাচার চক্রের প্রলোভনে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা প্রতি বছরই ভূমধ্যসাগর ও বঙ্গোপসাগরে প্রাণ হারাচ্ছে। কিন্তু মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। ২০১২ সালে মানব পাচার আইন হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৭১৬টি মামলা হয়েছে। কিন্তু ওই মামলাগুলোর নিষ্পত্তির হার খুবই সামান্য। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওসব মামলার অধিকাংশেরই এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি। পাচার রোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়ায় গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচার প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে’ রাখা হয়েছে। মানব পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান অনেক উপরে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত মাসের শুরুর দিকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে তিউনিসিয়ার উপকূলে নৌকা ডুবিতে ৩৭ জন বাংলাদেশী নিহত হন। প্রাণে বেঁচে যায় ১৪ জন। জীবিত ১৪ জনকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। তাছাড়া অতিসম্প্রতি তিউনিসিয়ার উপকূলে ৬৪ বাংলাদেশী দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নৌকায় ভাসছিল। তাদের তিউনিসিয়া গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছিল না। বরং তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষ দেশে ফেরত পাঠানোর কথা ঘোষণা করে। ইতালি যাওয়ার পথে তারা তিউনিসিয়া উপকূলে কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ে। তাদের উদ্ধারে রেডক্রিসেন্ট ও ইউএনএইচসিআরকেও (জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক কমিশন) তিউনিসিয়ার কর্তৃপক্ষ আটকে পড়াদের কাছে যেতে দেয়া হচ্ছিল না। তবে সাগরভাসাদের ইতালিতে যেতে না দিলেও তিউনিসিয়ায় কাজ করার সুযোগ দেয়ার দাবি করেছিল। তিউনিসিয়ার উপকূলে সাগরেভাসা বাংলাদেশীরা লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। ওই স্বপ্ন এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তাই তাদের ইতালি যেতে না দেয়া হলেও তিউনিসিয়ায় কাজ পাওয়ার সুযোগ চাচ্ছে। কারণ কপর্দকশূন্য হয়ে দেশে ফেরার কোন সুযোগ নেই। কিছু দিন তিউনিসিয়ায় কাজ করে কিছুটা খরচ তুলে দেশে ফিরতে চান তারা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে লিবিয়ায় জনশক্তি পাঠানো বন্ধ রয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে লিবিয়া উপকূল থেকে নৌকাযোগে ইউরোপে প্রবেশ করছে অনেক বাংলাদেশী। আদম ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়ে যাচ্ছে। আর সেখানে যাওয়ার সময় প্রায়ই নৌকাডুবির দুর্ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া মালয়েশিয়ায়ও আবার সাগর পথে মানব পাচার শুরু হয়েছে। পাচারকারী চক্রের টার্গেট গ্রুপ এবার রোহিঙ্গা। পাশাপাশি কিছু বাংলাদেশী নাগরিককেও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মাছ ধরার নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যাচ্ছে। পাচারকারী চক্রের প্রলোভনে বহু মানুষ বড় অংকের টাকা দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে উত্তাল সাগর। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। তাছাড়া থাইল্যান্ডে কয়েকটি বড় গণকবর পাওয়া যায়। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে মানব পাচার বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কিছু দিন মানব পাচার বন্ধ থাকার পর তা আবার শুরু হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ থেকে যত মানব পাচার হচ্ছে তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে থেকেই হয় না। ওই কারণে সরকারকে এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি। সেজন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। তা না হলে ভবিষ্যতে অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে পারে। বেশিরভাগ মানব পাচারই হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। এক শ্রেণীর দালালের মাধমে অভিবাসনপ্রত্যাসীরা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছে। তাতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। সেখান থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে। সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার তেমন প্রয়োগ হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও পাকিস্তানে বেশিরভাগ পাচার হচ্ছে নারী। তাদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিষহ। পাচারকারীরা দালালদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। দালালদের হাতে পড়ার পর তাদের জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। অথবা অন্য কোন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন।
এদিকে গত বছর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার নারী ভারতে পাচার হয়। তবে এতো বিপুলসংখ্যক নারী পাচার হয় কিনা তা নিয়ে সংশয় থাকলেও প্রতিবছর যে নারী পাচার হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় নেই। সম্প্রতি শ্রম অভিবাসনের নামেও পাচার বাড়ছে। বিদেশে কাজের চাহিদা থাকায় অনেক নারী কর্মী বিদেশে গিয়ে শ্রম অভিবাসনের আড়ালে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছে। সাড়ে ৩ বছর আগেও সাগরপথ দিয়ে হাজারো মানুষের মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে খবর হয়েছিল। মিয়ানমার থেকে ২০১৭ সালে ফের বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশ পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক করে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গত কয়েক মাসে পাচারকালে অনেক নারী ও শিশুকে উদ্ধারও করেছে। দেশের অভ্যন্তরেও মানব পাচার থেমে নেই। সরকার মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (এনপিএ ২০১৮-২০২২) গ্রহণ করেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানব পাচার বিষয়ক মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদেগর মতে, মানব পাচার নিয়ে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা উচিত। পাচারকারীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। ইতোমধ্যে পাচারের জন্য আরেকটি উপসর্গ তৈরি হয়েছে। সেটা হচ্ছে শ্রম অধিদফতরের নামে মানব পাচার। তাতে পাচারের বৈধতা দেয়া হচ্ছে। পাচারকারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভিকটিমরা উদ্ধার হলেও পুলিশ পাচারের মামলা রুজু না করে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। মানব পাচার প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সময়োপযোগী ও সর্বজনীন আইন প্রণয়ন জরুরি। প্রতিটি জেলায় পাচারের মামলা মনিটরিং সংক্রান্ত কমিটি থাকলেও তার বেশিরভাগেরই কোন কার্যক্রম নেই। তাছাড়া দায়েরকৃত মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত রিপোর্ট দেয়া হয় না। আদালতের স্বল্পতা ও দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পাচারের মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়। ওই কারণেই পাচারকারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। কিছু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে পাচারকারীরা মানব পাচারে সাহস পেত না।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রধান শরীফুল হাসান জানান, সাগরভাসা মানুষদের উদ্ধারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা যেটা করছি যারা সাগরে নৌযানে আটকা পড়েছে তাদের পরিবারের খোঁজ খবর রাখছি। ইতোমধ্যে কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। তারা কিভাবে সেখানে গেল কারা তাদের এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে নিলো এ বিষয়গুলো বের করার চেষ্টা করছি। তবে ভাল চাকরির আশায় দালাল চক্র বাংলাদেশ থেকে লোক সংগ্রহ করে দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ার উপকূল দিয়ে ইউরোপে পাচার করে আসছে। এ বছরের শুরু থেকে ১৬৪ জন সাগরে ডুবে মারা গেছেন। সাগরপথে কড়াকড়ির কারণে কিছু দিন বন্ধ থাকার পর আবারো সাগর পথে শুরু হয়েছে মানব পাচার। গোপনে পাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত সাগর পথে ইউরোপ পাড়ি দেয়ার সময় নৌকা ডুবে মারা গেলেও খবর আসে না। এবার বেশিসংখ্যক বাংলাদেশী মারা যাওয়ার বিষয়টি বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। গত মাসের শুরুর দিকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবে অন্তত ৬৫ জন মারা গেছে। তার মধ্যে মৃতের তালিকায় ৩৭ জন বাংলাদেশী রয়েছে। আর জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ১৪ বাংলাদেশী।