বিভাগীয় শহর বরিশালসহ ছয়টি জেলায় চিকিৎসকদের ৭৬২টি পদ শুন্য থাকায় অনেকটা মুখ থুবড়ে পরেছে স্বাস্থ্যসেবা। স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্বেও যারা কর্মরত রয়েছেন তার অধিকাংশই হচ্ছেন শহরমুখী। ফলে চিকিৎসকের অভাবে উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে শতকরা ৬৭ ভাগ চিকিৎসকের পদ দীর্ঘদিন থেকে শুন্য রয়েছে। বাকি ৩৩ ভাগ চিকিৎসকের অধিকাংশরাই থাকেন জেলা শহরে। ফলে বিভাগের প্রতিটি জেলা ও উপজেলার সর্বস্তরের রোগীদের জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসাস্থল হচ্ছে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের ছয়টি জেলায় চিকিৎসকের মোট এক হাজার ১৩১টি পদের মধ্যে ৭৬২টি পদ শুন্য রয়েছে। এরমধ্যে বরিশাল জেলায় ২৫৮টি পদের মধ্যে ১৫৭টি পদ শুন্য। অর্থাৎ এখানে ৬১ ভাগ চিকিৎসক নেই। একইভাবে পটুয়াখালীতে ২২৩টি পদের বিপরীতে ১৪৭টি পদ শুন্য রয়েছে। শুন্যপদের হার ৬৬ ভাগ। ভোলায় ২০৯টি পদের বিপরীতে ১৪৬টি শুন্য। এখানে শুন্যপদের হার ৭০ ভাগ। পিরোজপুরে ১৭২টি পদের বিপরীতে শুন্য ১১৬টি। শুন্য পদের হার ৬৮ ভাগ। বরগুনায় ১৬৫টি পদের মধ্যে শুন্য ১৩০টি। এ জেলায় শুন্য পদের হার সবচেয়ে বেশি ৭৯ ভাগ। ঝালকাঠিতে ১০৪টি পদের বিপরীতে শুন্য ৬৬টি। শুন্যপদের হার ৬৪ ভাগ।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মোশতাক আল মেহেদী বলেন, হিসাব অনুযায়ী চিকিৎসকের ৬৭ ভাগ পদ শুন্য রয়েছে। তবে পেষণ ও অন্যসব কারণে এ হার আরও বেশি হবে। তাই পেষণ বন্ধ করার জন্য আমরা সুপারিশ করেছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কার্যালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, একজন চিকিৎসক পদায়ন হওয়ার পরই মহাপরিচালকের (ডিজি) কার্যালয়ের মাধ্যমে ঢাকা বা বড় শহরে পেষণে চলে যায়। আঞ্চলিক কার্যালয় ওই তথ্য জানতেও পারে না। কর্মস্থলে না থাকলে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতাও আঞ্চলিক কার্যালয়ের নেই। সূত্রমতে, বরিশালে এমন অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে যেখানে মাত্র ২/১জন চিকিৎসক রয়েছেন। আবার কোনো কোনো হাসপাতালে তদবিরের কারণে বেশিসংখ্যক চিকিৎসককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মেঘনা নদী ঘেরা হিজলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তীব্র চিকিৎসক সংকট থাকায় সেখানে প্রতিনিয়ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
হিজলা উপজেলার বাসিন্দা জেলে হারুন-অর রশিদ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকরা থাকেন না। আর চিকিৎসক না থাকায় রোগীরা সেবাও পায়না। যে ২/১ জন চিকিৎসক রয়েছেন তারাও হাসপাতালের পাশের বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দায়িত্ব পালন করেন। অনেকে বরিশালে ব্যক্তিগত চেম্বার খুলে বসেছেন।
বরিশাল আধুনিক জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ হাসপাতালে ৩২জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত আছেন ২৫জন। হাসপাতালের আরএমও ডাঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, চিকিৎসক সংকটের মাধ্যমেই হাসপাতালে আগত রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের সেবার মান নিয়েও রোগীদের ক্ষোভ রয়েছে। তাদের অভিযোগ, চিকিৎসকরা হাসপাতালে মানসম্মত চিকিৎসা দিচ্ছেন না। তারা বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
বরিশাল সিভিল সার্জন ডাঃ মনোয়ার হোসেন বলেন, সারাদেশেই চিকিৎসক সংকট রয়েছে। তবে বরিশাল বিভাগে সংকট বেশি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিব অবহিত আছেন। নতুন চিকিৎসক যোগদান করলে এ সংকট কমে যাবে। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কনসালটেন্টসহ পাঁচজন চিকিৎসক থাকতে হবে। তবে বরিশালেল প্রতিটিতেই পাঁচজনের কম চিকিৎসক আছেন। এরমধ্যে হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, মুলাদী অবহেলিত এলাকা। এসব এলাকায় চিকিৎসক সংকটে স্বাস্থ্যসেবা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের বরিশাল জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন বলেন, চিকিৎসাসেবা বৃদ্ধিতে তেমন উদ্যাগ দেখা যায়না। এখানে চিকিৎসকরা যে সেবা দিয়ে থাকেন তাতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমেনি। এরমধ্যে প্রতিটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে দালালদের তৎপরতা আছে। তিনি আরও বলেন, গোটা বরিশালে রোগীর তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা অতি সামান্য। এতোকম চিকিৎসক দিয়ে সেবা দেয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে তিনি দ্রুত সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক ডাঃ আবদুর রহিম বলেন, বরিশাল বিভাগের ৪০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। পাশাপাশি জেলা শহরে জেনারেল হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে দীর্ঘদিন থেকেই চিকিৎসক সংকট রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পাঁচজনের কম চিকিৎসক কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখা যাবেনা। কিন্তু এর চেয়েও কমসংখ্যক চিকিৎসক কোনো কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে। ৬৭ ভাগ কম চিকিৎসক দিয়ে আমরা স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। তিনি আরও বলেন, প্রতিনিয়ত চিকিৎসক সংকটের সমাধানের জন্য মন্ত্রণালয়ে আমরা রিপোর্ট করছি।