সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা অর্থমন্ত্রী ডেঙ্গু জ্বরের যে অভিজ্ঞতার কথা জাতীয় সংসদে বিশদভাবে বলেছেন, তা থেকে এর ভয়াবহতা বোঝা যায়। তিনি সর্বোচ্চ চিকিৎসা সুবিধার মাধ্যমে সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে যে ধরনের চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব নয়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে তার ভয়াবহতা কেবল আক্রান্ত ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারেন। এই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবারের বাজেট পুরোপুরি পেশই করতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘বাজেট পেশের দিন সংসদ শুরুর আগে যখন সংসদে প্রবেশ করি, তখন থেকে পরবর্তী ৭-৮ মিনিট আমি পুরোপুরি ব্ল্যাঙ্ক ছিলাম। কোনো কিছুই মনে পড়ছিল না। কোনো রকমে গিয়ে সিটে বসেছি। তখন কেবল মনে হচ্ছিল প্রবল এক ভূমিকম্প পৃথিবীতে আঘাত হানছে। আমি যেন সিট থেকে পড়ে যাচ্ছি। হাতে কোনো শক্তি ছিল না। বাজেটের পাতাগুলো উল্টাতে পারছিলাম না। চোখেও কিছু দেখছিলাম না।’ ডেঙ্গুর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তিনি এভাবেই বর্ণনা করেন। কাজেই যারা ডেঙ্গুতে বা চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, তারা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এর যন্ত্রণা বোঝা সম্ভব নয়।
বলা বাহুল্য, রাজধানীবাসী বরাবরই মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই মশার উৎপাত শুরু হয়। এতে স্বস্তিতে থাকা যায় না। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় চরম বিঘœ ঘটে। এ সমস্যা যেন কোনোভাবেই দুই সিটি করপোরেশন সমাধান করতে পারছে না। মশা নিধনে ওষুধ কেনা বাবদ বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও মশা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। এর পেছনে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। নিণ্ম মানের ওষুধ এবং সঠিক সময়ে সঠিকভাবে না ছিটানোর কারণে মশা নিধন করা যাচ্ছে না।
রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বিগত বছরগুলোর চেয়ে এ বছর ভয়াবহ ও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীতে দিন দিন বেড়েই চলেছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ। চলতি জুলাই মাসের প্রথম ৬ দিনে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৭৯ জন। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে ৭৪৬ জন। শুধু রাজধানীই নয়; রাজধানীর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাসজনিত ডেঙ্গু জ্বর। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আবহাওয়ার তাপমাত্রা বেশি থাকলে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার প্রজনন বেশি হয়, আর বৃষ্টির কারণে স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ছে। তাই জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য এ হিসাব হাসপাতালের দেয়া তথ্য মোতাবেক। এর বাইরে আর কতজন মারা গেছে তার হিসেব নেই। এমন অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রয়েছের যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়নি বা হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী এবং এতে মৃত্যুবরণকারীর হিসাব সঠিকভাবে পাওয়া দুষ্কর। তবে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দেখেই বোঝা যায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোকে গত বছর থেকে ডেঙ্গুর চিকিৎসার ব্যাপারে নজরদারিতে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলেও এটাকে আরও বেগবান করা প্রয়োজন। ইতোপূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৭ সালে রাজধানীর ধানমন্ডির গ্রিন রোডে এক বেসরকারি হাসপাতালে তাকে ডেঙ্গুর বদলে ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তখন ভুল চিকিৎসায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকারও করেছিলেন হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আশার কথা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবছর বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেওয়া উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। এটা নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভাকক্ষে এডিস মশাবাহিত রোগের (ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া) প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ ও ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন সম্পর্কিত এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর, জাতীয় ডেঙ্গু গাইডলাইনের এডিটর-ইন-চিফ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ডেঙ্গু ও এডিস মশাবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার প্রমুখের উপস্থিতিতে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডেঙ্গু চিকিৎসার হালনাগাদ প্রটোকল সব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ডেঙ্গুর ধরন এবং প্রাথমিক আলামতের পরিবর্তন ঘটায় চিকিৎসা, গাইডলাইন বা প্রটোকলে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। সব চিকিৎসকের কাছে ব্যাখ্যাসহ নতুন প্রটোকল পৌঁছে দেওয়াটা জরুরি। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে ডেঙ্গু রোগীকে কোনো অবস্থাতেই নতুন প্রটোকলের (যা জাতীয় গাইডলাইন ২০১৮ হিসেবে পরিচিত) বাইরে অন্য কোনো চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে যাদের একাধিক মৃত্যুঝুঁকি বা কো-মরবিডিটি (যেমন শিশু, প্রবীণ গর্ভবতী, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) আছে, তাদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে অবশ্যবর্জনীয় বিষয়গুলো হলো ডেঙ্গু রোগীকে প্যারাসিটামল ছাড়া এনএসএআইডি, স্টেরয়েড, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, প্লাটিলেট কনসেনট্রেট দেওয়া যাবে না। অনিবন্ধিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গুর চিকিৎসা করা যাবে না, ইত্যাদি।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দ নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যেহেতু এডিস মশা এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে, যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে। তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোলা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। ঘরের বাথরুমে বা কোথাও জমানো পানি পাঁচ দিনের বেশি যেন না থাকে। অ্যাকুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ারকন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে। এডিস মশা সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যায়, কখনো কখনো দিনেও কামড়ায়। তাই দিনের বেলা শরীরে ভালোভাবে কাপড় দিয়ে ঢেকে বের হতে হবে। বাচ্চাদের যারা স্কুলে যায়, তাদের হাফ প্যান্ট না পরিয়ে ফুল প্যান্ট পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে, এ ব্যাপারে পিতা-মাতার কেয়ার নেয়া খুবই জরুরি।
চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যু না হলেও এর ভয়াবহতা ব্যাপক। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে প্রচ- জ্বরের পাশাপাশি শরীরে নিদারুণ যন্ত্রণা হয়, আর জ্বর সেরে যাওয়ার পরও গিঁটে গিঁটে অসহ্য ব্যথা হয়। এই জ্বরে আক্রান্তের সঞ্জীবনী শক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা পর্যন্ত করা যায় না। কিন্তু আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এ রোগ থেকে উপশম দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এই জ্বর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে এটি শরীরে জটিলতা সৃষ্টি করে। তবে জ্বরে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে ও বিশ্রামে থাকলে কয়েক দিনেই রুগি পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে।’
ডেঙ্গু মশা নির্মূল ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন গত কয়েকদিন মাইকিং করছে। ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশন পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে পরামর্শ দিয়েছে। তারা বাড়িঘরের আশপাশ ও আঙ্গিনায় জমে থাকা স্বচ্ছ পানি অপসারণ করার পরামর্শ দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগে কেউ আক্রান্ত হলে তার সাথে পরিবারের সদস্যদেরও ভোগান্তির শেষ থাকে না। হাসপাতালে ছুটাছুটি এবং অর্থের ব্যয় ছাড়াও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে মশা এবং ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নিধনই কেবল পারে সাধারণ মানুষকে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা করতে। কেবল বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক, ভয়ভীতি, ডেঙ্গু প্রতিরোধ বা নসিহত করলেই হবে না, উভয় সিটি কর্পোরেশনকে মশা নিধনের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মূল কাজটি তাদেরকেই করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে নগরবাসীকে সচেতন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভিযান পরিচালনায় সিটি কর্পোরেশনকে সহায়তা করতে হবে। কেননা, সর্বসাধারণ যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের ব্যাপারে সতর্ক, সচেতন না হয়, কোন সরকার বা কর্তৃপক্ষের পক্ষেই সম্ভব নয় শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা। এজন্য নগরবাসীকেও নিজের, পরিবারের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়ি-ঘর ও আশপাশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংসে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।
সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস, বিশেষ করে গরম ও বর্ষার সময় এডিস প্রজাতির মশার বিস্তার ও ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। এ বছর ডেঙ্গুর ধরন ও ভয়াবহতা নিয়ে শুরুতে যে মাত্রার আশঙ্কা ছিল, পরিস্থিতি তার চেয়ে জটিল ও ভয়ংকর বলে আলামত পাওয়া যাচ্ছে।
নিজ বাড়ির আঙিনা ও চারপাশও পরিষ্কার রাখতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে অন্য কোনো মশা তাকে কামড়াতে না পারে। কারণ, অন্য মশার মাধ্যমে এ রোগ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।