নানা অনিয়ম, বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি, দুর্নীতি, পরিচালকদের নামে-বেনামে টাকা বের করে নেয়া, আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারাসহ চরম অব্যবস্থাপনা ও অর্থ সংকটের কারণে অবসায়ন (লিকুইডেশন) করা হয় ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডকে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ বা দেউলিয়া হয়ে গেলো। এ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেখভালের দায়িত্বও ছিল এ তাদের। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে কী? করলে প্রতিষ্ঠানটির এমন পরিণতি হতো? সময়মতো পর্ষদ ভেঙে দিলে এত খারাপ অবস্থা হতে পারতো না। তদারকি দুর্বলতা ও পরিচালকদের অনিয়মের কারণেই প্রতিষ্ঠানটি এখন দেউলিয়া।
বন্ধের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই অনেক আমানতকারী পিপলস লিজিংয়ের অফিসে আসছেন। কিন্তু তথ্য জানানোর মত গুলশান ও মতিঝিল ব্রাঞ্চ অফিসে কাউকে পাওয়া যায়নি। বাবলা নামে এক আমানতকারী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘কষ্টের টাকা জমিয়ে ডিপোজিট রেখেছি, এখন যদি ফেরত না পাই তাহলে মাঠে মারা যাব।’ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত থাকা কর্মকর্তারা নিজেদের পরিচয় দিতে চাচ্ছিলেন না। আমানতের অর্থ ফেরত চাইতে প্রধান কার্যালয়ে যারা এসেছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরি থেকে অবসর নেয়া বৃদ্ধ, বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মরত ব্যাংকার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত সদস্য, গৃহিণীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের প্রত্যেকের চোখে-মুখে ছিল সঞ্চয়কৃত অর্থ খোয়ানোর ভয়। কেউ কেউ ছিলেন মারমুখো ও ক্ষুব্ধ।
জানা গেছে, প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার আমানত ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। এমন অবস্থায় আর্থিক এই প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলে আমানতকারীদের এক টাকাও ফেরত পাওয়ার কোনও বিমা নিশ্চয়তা নেই। কারণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোনও আমানত বিমা নেই। যার ফলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অবসায়নের পর আদালতের দ্বারস্থ হতে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত, আমানতকারীর অর্থ ফেরতসহ দায়-দেনা কীভাবে মেটানো হবে, তা আদালতের আদেশে নির্ধারিত হবে।
জানা যায়, পিপলস লিজিং থেকে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালকরা বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নিয়েছেন। ভুয়া কাগজ তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালকরা। সেই ঘটনায় ২০১৫ সালে পাঁচ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে শুধু প্রতিষ্ঠানের নামে জমি কেনার কথা বলে নিজ নামে জমি রেজিস্ট্রি করার ঘটনায় আত্মসাৎ হয় প্রায় সাড়ে পাঁচশ' কোটি টাকা। জমি রেজিস্ট্রির এ জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক চেয়ারম্যান মতিউর রহমান ১১৬ কোটি, সাবেক পরিচালক খবির উদ্দিন মিয়া ১০৭ কোটি, আরেফিন সামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন ও হুমায়রা আলামিন ২৯৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন মর্মে ওই সময় দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রতিবেদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম এবং নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম জানান, পিপলস লিজিংয়ের আমানতের তুলনায় সম্পদের পরিমাণ বেশি। তাদের আমানতের পরিমাণ ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বিপরীতে সম্পদ আছে ৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এ কারণে আমানতকারীদের শঙ্কার কিছু নেই। আমানতকারীরা কতদিনের মধ্যে অর্থ ফেরত পাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, যেহেতু আমরা আদালতে যাচ্ছি, এটা এখন আদালতের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমানতকারীদের শতভাগ অর্থ ফেরত দেয়া হবে কি-না, জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটাও সিদ্ধান্ত নেবেন আদালত।
এর আগে এরকম অবসায়ন না হলেও ব্যাংক একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ এবং নাম পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে পদ্মা ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক এবং শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের নাম বদলে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কিন্তু এসব দেউলিয়া ব্যাংকের গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি। এমনকি ১৯৯২ সালে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল বিলুপ্ত হয়ে ইষ্টার্ন ব্যাংক গড়ে উঠেছিল, কিন্তু ব্যাংকের বিভিন্ন দেশের গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি। শুধু তাই নয়, ভারত বিভক্তির পর দেউলিয়া হওয়া পাইওনিয়ার ব্যাংক এবং ক্যালকাটা মডার্ন ব্যাংকের লিকুইডেশনের সমস্যা এখনও সমাধান হয়নি। তাহলে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ারহোল্ডার, সাধারণ আমানতকারীরা এখন আদালত, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনের গ্যারাকলে ঘুরে কবে, কখন টাকা পাবেন?