সিলেটের এক প্রাচীন রেলওয়ে স্টেশনের নাম ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশন। গত ১২ আগস্ট থেকে তালা ঝুলছে এ স্টেশনে। বিক্রি হচ্ছেনা টিকেট, বুকিং হচ্ছেনা মালামাল। ফলে বেড়ে চলেছে যাত্রী দুর্ভোগ। রেল বিভাগের অযতœ আর অবহেলায় পড়ে থাকা ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশনে লোকাল ট্রেন থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভাগ। প্রাচীন বাণিজ্যিক কেন্দ্র ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের মালামাল উঠানামা ও যাত্রীসাধারণ থেকে একসময় বিশাল আয়ের স্টেশন হলেও কালের বিবর্তণে ন্যুয়ে পড়েছে প্রাচীন এই স্টেশনটি। বাঁশ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে টিনের চাল। দেখে মনে হয় যেনো এক সময়ের কামধেনুরূপী স্টেশনটি কোন এক কালবৈশাখী ঝড়ে উপড়ে নিয়ে যাবে পাশর্^বর্তী গাড়লী বিলে। তবে রক্ষাণাবেক্ষনের দায়িত্বে থাকা মাইজগাঁও স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক জহরলাল দাস চাইলে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে পারেন জানালেন সম্প্রতি এই স্টেশন থেকে অবসর উত্তর ছুটি’তে যাওয়া পোর্টার মোঃ সিরাজ। যিনি ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশন থেকে পেশনে প্রায় আঁধা কিলোমিটার দূরে মাইজগাঁও স্টেশনের বুকিং ক্লার্কের দায়িত্ব পালন করছেন। তবে স্টেশনে বদলি লোক না থাকায় বিপাকে পড়ছেন পোর্টার মোঃ সিরাজ। গত ১১ আগস্ট তারিখে শেষ কর্মদিবস শেষে পিআরএল’এ চলে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। পিআরএল’র চিঠি হাতে নিয়ে সাবেক কর্মস্থলে রাত কাটাচ্ছেন তিনি। জনবল না থাকায় বন্ধ রয়েছে স্টেশনের কার্যক্রম। স্থানীয়দের আশঙ্কা প্রাচীন এই স্টেশন হঠাৎ বন্ধের ঘোষনা আসতে পারে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভাগ থেকে।
হজরত শাহজালাল (রঃ)’র অন্যতম সফর সঙ্গী হজরত শাহমালুম (রঃ)’র মাজার টিলার নীচেই সিলেটের প্রাচীনতম রেলওয়ে স্টেশন ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশন। জানা যায়, প্রায় শতাধিক বছর পূর্বে বৃটিশ শাসনামলে কুশিয়ারা রেলওয়ে সেতু নির্মানকালীন সময়ে শাহমালুম (রঃ)’র মাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার ও পাশর্^বর্তী খাদ্য গুদাম’কে কেন্দ্র করেই ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশনটি স্থাপিত হয়েছিল। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বাজারের মালামাল উঠানামা ও যাত্রীদের কোলাহলে মুখরিত ছিল ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশন। কালের পরিক্রমায় ও রেল বিভাগের অযতœ অবহেলায় ঝরাজির্ণ অবস্থায় পড়ে আছে স্টেশনটি। জনশ্রুতি আছে অতিতে স্টেশন এলাকায় বড় আকারের কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলেও হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি।
শনিবার বিকেল ৩ টায় সরেজমিন ফেঞ্চুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় তালা ঝুলছে স্টেশনে। সিলেট থেকে আখাউড়াগামী লোকাল ট্রেন কুশিয়ারা আসবে তাই ১০/১২ জন যাত্রী ঘুরাফেরা করছেন টিকেট কাউন্টরের পাশে। জিজ্ঞেশ করতেই তাঁরা জানালেন, কাউন্টারে তালা ঝুলছে দেখে দীর্ঘসময় থেকে অপেক্ষা করছি, কাউকে খোঁজে পাচ্ছিনা। এ সময় দেখা হয় সম্প্রতি এই স্টেশন থেকে অবসর উত্তর ছুটি’তে যাওয়া পোর্টার মোঃ সিরাজ মিয়ার সাথে। তিনি জানান, যাত্রীদের দেখে আমারও খারাপ লাগছে, কিন্তু কি করবো টিকেটে হাত দেওয়ার ক্ষমতা আজ আর আমার নেই। গত ১০ আগস্ট আমার বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হওয়ায় অবসর উত্তর ছুটি’র চিঠি হাতে নিয়ে বসে আছি। ১১ আগস্ট থেকে পিআরএল কাটাতে বাড়ী যাওয়ার কথা ছিল আমার, কিন্তু বিধিবাম! এই চাবি ও হিসেব নিকেশ কার হাতে দিয়ে যাবো সেই বদলি লোক থেকেও নেই। আশা ছিল বাড়ী গিয়ে স্ত্রী সন্তানদের সাথে ঈদ করার, তাও হলোনা। পোর্টার মোঃ সিরাজ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পেশনে থাকা মাইজগাঁও স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক জহরলাল দাস চাইলে আপাতত এই দায়িত্ব নিয়ে স্টেশনের কার্যক্রম চালু রাখতে পারতেন, অব্যাহত থাকতো স্টেশনের দৈনিক আয়। কারণ তিনি গত ৩ বছর আগে ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশনে যোগদান করে পেশনে মাইজগাঁও স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
পোর্টার সিরাজ আরো জানান, এক সময়ের চরম ব্যাস্ততাপূর্ণ এ স্টেশনটির এ বছরে গত ৭ মাসে আয় হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৬৮ টাকা। এ হিসেবে গড়ে প্রতিমাসের আয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা, যা শুধুমাত্র মেইল, কুশিয়ারা ও জালালাবাদ এই ৩ টি লোকাল ট্রেন থেকে এসেছে। সেকেলের পুরনো নীচু প্লাটফর্ম, ঝরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবকাটামোর ফলে মালামাল উঠানামা ও যাত্রীদের আসা-যাওয়া অনেকটা কমে গেছে। ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশনের দায়ভার হস্তান্তরে একটি লিখিত আবেদন নিয়ে ঢাকা যাচ্ছেন জানালেন পোর্টার মোঃ সিরাজ।
এ ব্যাপারে মাইজগাঁও স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক জহরলাল দাস জানান, উর্ধ্বতনের আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত বদলি দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। পেশনে থাকলে কি হলো মাইজগাঁও স্টেশনে ডিউটির মধ্য দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশনের রক্ষাণাবেক্ষনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। আদেশ ব্যাতিত বদলি দায়িত্ব নেয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।
এ সময় কথা হয় মাইজগাঁও স্টেশন মাস্টার চন্দ্র বিনদ সিংহ সামন্ত’র সাথে। তিনি জানান, মাইজগাঁও স্টেশনের সাথে ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশনের ব্যাস্ততা ও আয় আকাশ পাতাল সমতুল্য। বুকিং ক্লার্ক জহরলাল দাস ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশনে যাওয়ার বিধান নেই। পোর্টার মোঃ সিরাজ পিআরএল’এ যেতে এত ব্যাস্ত হয়েছেন কেনো? বদলি লোক না আসা পর্যন্ত সরকারি সম্পদ পাহারা দিয়ে রাখার দায়িত্ব উনাকেই নিতে হবে, প্রয়োজনে বছর গড়াতেও পারে! তবে ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হবে, এমন খবর জানা নেই বলে জানালেন মাইজগাঁও স্টেশন মাস্টার চন্দ্র বিনদ সিংহ সামন্ত।
হজরত শাহমালুম (রঃ)’র মাজারের খাদেম আবুল হোসেন শাহ জানান, বিশেষ করে এই ওলির মাজার ও ঐতিহ্যবাহী ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারকে কেন্দ্র করে এই স্টেশনটি স্থাপিত হয়েছিল। জেনেছি কুশিয়ারা রেলওয়ে ব্রীজ স্থাপনের সময় তৎকালীন জনৈক প্রকৌশলী মাজারে দোয়া ও শিরনি বিতরণ করে ব্রীজ স্থাপনে সফলকাম হয়েছিলেন। এ ছাড়া মাজারের পবিত্র ওরুসে বছরে প্রায় লাখো মানুষের ঢল নামে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। এক সময়ের বিশাল আয়ের এই স্টেশনটি রেল বিভাগের অযতœ অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর প্রাচীন ঐতিহ্য।
জরুরী ভিত্তিতে ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশনের কার্যক্রম চালুর দাবি জানিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসী ও ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ীরা জানান, একজন ওলি আউলিয়ার মাজার সংলগ্ন প্রাচীন এই স্টেশনটি রেল বিভাগের নতুন নকশায় নির্মিত হলে আবারো প্রাণচাঞ্চল্য হয়ে উঠবে ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশন, ফিরে পাবে তাঁর প্রাচীন ঐতিহ্য।