ভূত তাড়াতে গিয়ে ১৩ বছরের কন্যাকে হত্যা করলো পিতা। এমন একটা সংবাদ পত্রিকার পাতায় পড়ার পর থেকে নিজের মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত রাইসা রিমা। তিনি ছোট একটা সরকারী চাকুরী করেন। স্বামী অনজন চৌধুরীও তার মতই একটা ছোট্ট চাকুরী করেন। বলা যায় ছোট সংসার সুখের সংসার ছিল একমাত্র কন্যা নিতুকে নিয়ে। নিতুর আনন্দকে দু’জনে ভাগাভাগি করে মোটামুটি মাপের একটা সংসার চলছিল তাদের। এই সংসারে রঙধনু ছিল সবসময়ই। কালোমেঘের আনাগোনা শুরু হয় নিতুর একযুগ পূর্তি হওয়ার পর থেকে। যাইহোক, সংবাদটা একটু পড়িতো; মনে মনে বলে চোখ রাখে পত্রিকার শেষ পৃষ্টায় ডানপাশে সিঙ্গেল কলামে ট্্িরটম্যান্ট দিয়ে প্রকাশিত সংবাদের উপর। সেখানে শুরুটা হয় এভাবে- ‘অশুভ ভূত তাড়াতে গিয়ে ৫০ বছরের এক ব্যক্তি তার ১৩ বছরের কন্যাকে হত্যা করেছে। চেয়ারের সাথে তার হাত-পা বেঁধে মাথায় পানি ঢেলে "অশুভ আত্মা"কে দূর করতে গিয়ে পিতা ও গীর্জার পাদ্রী মিলে এই কান্ড ঘটায়। কুমামোতো প্রিফেকচারাল পুলিশ মেয়েটির পিতা আৎসুশি মাইশিগি এবং ৫৬ বছর বয়সী পাদ্রী কাজুআকি কিনোশিতাকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মাইশিগির কন্যা তোমোমিকে মারাত্মকভাবে জখম ও পরিনতিতে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে এই দু'জনে তোমোমির উপর গত মার্চের পর থেকে অন্ততঃ ১০০ বার এই প্রক্রিয়া চালিয়েছে। এই তথাকথিত শাস্ত্রীয় আচার নাগাসুমাচির ধর্মীয় গ্রুপ নাকাইয়ামা-শিনগো-শোশু'র একটি গীর্জার ৩.৫ মিটার উঁচু মানব নির্মিত কনক্রীটের জলপ্রপাতের নীচে পালন করা হয়। মাটির নীচ থেকে পানি ২.৫ মিটার উঁচুতে পাম্প করে পাঠানো হয়।
অগাষ্টের ২৭ তারিখ রাত ৯টায় পাদ্রী জলপ্রপাতের নীচে তোমোমির হাত একটি চেয়ারের সাথে মুখ উপরের দিক করে বেঁধে রাখে। এভাবে পাঁচ মিনিট তাকে রাখা হয়। তোমোমি অজ্ঞান হয়ে পড়লে এম্বুলেন্স ডাকা হয়। ২৮ অগাষ্ট ভোর ৩.৪০ তোমোমি হাসপাতালে মারা যায়। তোমোমির পিতা পুলিশকে জানিয়েছেন, আমার মেয়েটাকে ভূতে পেয়েছিলো। সেজন্য আমরা ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে ভূত তাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু সে এক পর্যায়ে হিংস্র হয়ে ওঠে তাই তাকে চেয়ারে বেঁধে রাখতে হয়েছিলো। আটককৃত দু'জনেই কোন রকম নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছেন। তোমোমি প্রাইমারি স্কুলের সিনিয়র গ্রেডে থাকাকালীন সময় থেকেই কিছুটা মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। গত মার্চে মাইশিগি গীর্জা সফর করার মাধ্যমে সেখানে তাদের যাতায়াত শুরু হয়।’ নিতুর বেলায় এমন ঘটনা কোনভাবেই প্রত্যাশা করে না রাইসা। সে চায় নিতু আবার আগের জীবন ফিরে পাক। যেমনটি ছিল এক যুগ পূর্তি হওয়ার আগে। সেই সময়গুলোতে নিতুর লেখা ও নির্দেশনায় 'স্বপ্নবালিকা' নামে একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়। ব্যাস, তারপর থেকেই সারাগ্রামের মানুষের কাছে তার নতুন পরিচয় হয় 'স্বপ্নবালিকা'। শিল্পকলা একাডেমীতে চার বছরের রবীন্দ্র সঙ্গীত কোর্সে ভর্তি হয়েছিল নিতু। একই সময়ে একাডেমীর নাট্য বিভাগের কয়েকজনের সঙ্গে 'নাট্যালয়' নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। সুন্দর কণ্ঠ বলে তখন একাডেমীর পরিচালক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে দিয়ে উপস্থাপনার কাজটি করাতেন। বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করে বছর খানেক চলল আবৃত্তি চর্চা। মাথায় সারাক্ষণ ছিল গান, নাটক আর কবিতা। টিএসসি, শাহবাগ, চারুকলার পোকাগুলো যেন গান গাইত। ১১ বছর বয়সেই প্রচন্ড ডাকসাইটের অভিনেত্রী আর শিল্পী হিসেবে হয়ে ওঠে পরিচিত। সকালে গানের রেওয়াজ, তারপর ক্লাস, বিকেলে স্কুল থেকে ফিরেই নাটক দলের মহড়া আর রাতে পড়ালেখায় মন ডুবিয়ে থাকতো তাদের একমাত্র মেয়ে নিতু। সেই নিতু এখন নিরব- নিথর। প্রচন্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে রাইসার এখন, কিন্তু না এখন কান্নার সময় নেই। ভাবতে ভাবতে নিতুর ঘরে ঢুকলো সে। সাজানো গোছানো ঘর। চারপাশে নিতুর আঁকা ছবি। কবিতার কুটিরশিল্প। চমৎকার করে সাজানো ঘরে নিতু বসে আছে একা একা । দৃষ্টিটা ঘরের এককোনে। সেখানে সিতুর প্রিয় খরগোশ দু’টি ছুটোছুটি করছে। আর তাকাতে পারে না। মেয়ের চেহারার দিকে। চোখ ভিজে যাওয়ার আগেই সরিয়ে নেয়। চোখ পরে কম্পিউটারটির উপর। মনিটরের উপরে হরেকরকম ট্যাটু লাগানো। গতবছর ঈদে কোন জামা-কাপড় লাগবে না, আমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দাও। এমন আবদারের মুখে প্রিয় মানুষটিকে দু’জনের পুরো মাসের বেতন- বোনাস মিলিয়ে এই কম্পিউটারটিটি কিনে দিয়েছিল। সময়-সুযোগ থাকলে মাঝে-সাঝে রাইসাও বসেছে । ইদানিং বসেনি। আজ বসতে ইচ্ছে করতেই আর দেরি করে না। বসে বসে ভাবছে আর দেখছে ফেসবুকে নিতুর ‘হোমে’ কি কি আছে। হঠাৎ চোখ পড়ে নোটস-এর উপর। ক্লিক কওে এগিয়ে যায়। ভেসে ওঠে রুপালী ক্যারভাসে কালো কালো অক্ষরের লেখাগুলো- ‘দলটির প্রধান জাহিদা ঊর্মীকে দিয়ে নাট্যশীলনে আমরা একটি ওয়ার্কশপ করেছিলাম। মূকাভিনয় সম্পর্কে প্রথম তার কাছেই জেনেছিলাম। তখন দলটি জাদুর প্রদীপ নামের একটি মুকনাট্য নিয়ে কাজ করছিল। আমি স্বপ্ন দলে যোগ দিলাম। বছর পাঁচেক এ দলে কাজ করি। এর মধ্যে শিল্পকলায় মাইমের ওয়ার্কশপ করার সময় মূকাভিনেতা জনা আপার সঙ্গে পরিচয় হয়। ওয়ার্কশপ করানোর সময় তিনি আমাকে ভীষণভাবে পছন্দ করেন। তার এ স্নেহ আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল।' এক সময় আমার মনে হলো স্বপ্ন দলে থেকে নিজের মেধা প্রকাশ করতে পারছিন না। তাই মঞ্চে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করলাম। এ দলে থাকার সময় বিশ্ববরেণ্য মূকাভিনয় শিল্পী পার্থপ্রতীম মজুমদারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মঞ্চের পথ ধরেই এক সময় ভিজ্যুয়ালে ডাক পাই। একে একে অভিনয় করি সোনালী ডানার চিল, ললিতা, ঘটক বাকীবিল্লাহসহ ঈদের জন্য নির্মিত বিভিন্ন চ্যানেলের বিশেষ মূকাভিনয় অনুষ্ঠানে। ক্লোজআপ তারকা রাজীবের একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে গাওয়া গানে মূকাভিনয়ে মডেল হয়েছি। এছাড়াও বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন চিত্রে মডেল হয়েছি। এর মধ্যে পূর্বাচল প্রবাসী ও হাতিল ফার্নিচার উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিন। মুহম্মদ হান্নান পরিচালিত 'শিখন্ডী কথা' চলচ্চিত্রে জামাই চরিত্রে অভিনয় করেছি। ছবিটি এখন মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়াও আবীর শ্রেষ্ঠ'র 'ফেরারি ফানুষ' ছবিতেও কাজ করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন স্লোগান ৭১'এর 'গণহত্যা ৭১' নামে একটি মাইম নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি। একজন কিশোরী হিসেবে বাংলাদেশে মূকাভিনয় শিল্পে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করার নেপথ্যে আমার মা-বাবার অবদান অপরিসিম। আমার মা-বাবা দু’জনই তাদের ভালোবাসার সবটুকু আমার জন্য নিবেদন করেছেন। তাদের এই ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ। তবে ইদানিং আমি একটা সমস্যায় ভুগছি...
নোটটা আর শেষ করেনি নিতু। এখানেই থেমে গেছে। মনে পড়ে রাইসারা তাদের স্কুল জীবন থেকে নোটবুকে লেখা শুরু করেছিল প্রতিদিনের ছোটখাটো বিষয়গুলো। সে সময় কম্পিউটার ভাবাও যেত না। আর এখন তার মেয়ে ১৩ বছরের মেয়ে নিতু কম্পিউটার ব্যবহার করে। ঠিক নোটবুকে লেখার মত করে নোটও লিখেছে। কিন্তু... আর ভাবতে পারে না। গুলি খাওয়া বকের মত ছটফট করতে থাকে। এরই মধ্যে অনজন চৌধুরী বাসায় আসেন। দরোজায় নক করতেই দরোজা খুলে দেয় রাইসা।
- কোন পরিবর্তন হলো? মোজা খুলতে খুলতে প্রশ্ন আঁকেন অনজন চৌধুরী।
-না, তবে একটু জোড়জবরদস্তি করে দুপুরের খাবারটা খাওয়াতে পেরেছি।
আর কথা বাড়ে না। ফ্রেস হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে নিতুর ঘরে এসে বসে। নিতু তখনো খরগোশের এলোমেলো চলা আর দুষ্টুমি দেখছে। দেখে মনেই হবে না এই মেয়ে নাটক করেছে, সিনেমায় অভিনয় করেছে। কতসুন্দর একটার মেয়ে। অথচ সামান্য সময়ের ব্যবধানে মেয়েটি কেমন অন্যরকম ভুতুরে হয়ে গেছে। কি ঘটেছিল সেই রাতে? প্রশ্নবোধক শূণ্যতায় ঘুরতে থাকেন। এক সময় ফিরে আসে বাস্তবতায়। কোন উত্তর বের করতে পারেননি। ভাবনা থেকে শুধু এতটুকু পেয়েছেন যে, নিতুর প্রাইভেট টিচার একযুগ পূুর্তি অনুষ্ঠানের দু’দিন পর নিতুর সাফল্যের সূত্র ধরে একটা পার্টি দিয়েছিল। সেই পার্টি ছিল ঘরোয়া, কিন্তু অনেক লোকজন হয়েছিল। এক ফাঁকে বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিতুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যখন পাওয়া গেল, তখন অনেকটাই নিরব-নিথর হয়ে গেছে নিতু। রাত অনেক হয়ে যাওয়ায় আর এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হয়নি। তবে তার মাত্র পনেরদিনের মাথায় পুরোপুরি নিরব হয়ে যায়। কথা বলে না, গান গায় না, নাটক নিয়ে ভাবে না। নেই সেই চঞ্চলতা। কিন্তু কেন? এই উত্তরটাই খুঁজে পায় না তারা। তাহলে কি?
এই প্রশ্ন মাথায় রেখেই চোখ বন্ধ করেছিলেন অনজন চৌধুরী। খুব ভোরে ঘুম ভাঙে তার। রাইসা তখনো মেয়ের পাশে বসে আছে। ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু। রাইসাকে ঘুম ঘুম চোখে বসে থাকতে দেখে বলে
-যাও, ঘরে যাও। আমি বসি মেয়ের পাশে। সেদিন অনজন আর অফিসে যাননা। বাসাতেই থাকেন।
বিকেলে যখন রাইসা বাসায় ফেরে। অনেকবার নক করা সত্বে দরোজা খোলেন না অনজন চৌধুরী। পরে নিতুর রুমের পাশে এসে জানালঅর ফাঁক গলিয়ে চোখ রাখে ঘরের মধ্যে। যা দেখে, তাতে আর বাস্তবতায় থাকতে পারে না। পরের ঘটনা এখন আর মনে নেই রাইসার। এখন সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। ডাক্তার নার্স এসে বলেলন, আপনার স্বামী আর সন্তানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু আপনার বাবা-মা কেউ নেই?
কোন কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না রাইসা। কেবল তাকিয়ে আছে হাসপাতালের বেডে বিছিয়ে রাখা শাদা চাদরের উপর...