জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার তারাকান্দি অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ দানাদার ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা সার কারখানা। কারখানাটি গত ৯ মাস যাবত অ্যামোনিয়া গ্যাস প্লান্টের কনভার্টার হিটারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বন্ধ রয়েছে সার কারখানা। কিন্তু বিকল্প পন্থায় কারখানাটি চালু করতে ইউরোপ থেকে প্রসেস লাইসেন্সর একদল বিশেষজ্ঞ নিয়ে এলেও আজো কারখানা চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে কারখানাটির। অপর দিকে কারখানা বন্ধ থাকায় কারখানা সংশ্লিষ্ট প্রায় ৩৫হাজার শ্রমিক-কর্মচারীসহ পরিবহন সংশ্লিষ্ট আরো প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানাযায়, গত ২৭ নভেম্বর/১৮ইং তারিখ ভোর ৬টা কারখানায় অ্যামোনিয়া গ্যাস প্লান্টের কনভার্টার হিটারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি গ্রস্ত হয়। ফলে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিকল্প পন্থায় কারখানাটি চালু করতে ইউরোপ থেকে প্রসেস লাইসেন্সর একদল বিশেষজ্ঞ আনা হয়। কিন্তু কারখানাটি চালু করতে ৩৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। সেখান ইরোপিয়ান বিশেষজ্ঞ দর ২৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা তুলতে সক্ষম হলেও কারখানাটি চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ দলকে ৬৬ হাজার ইউরোর অথাৎ আরো কয়েকশ’ কোটি টাকা বিল দিতে হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও এক বৎসর কারখানা বন্ধ থাকলে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন কারখানা সংশিষ্টরা। এ ছাড়া কারখানা চালু অবস্থায় অ্যামোনিয়া তরল গ্যাস ডিলারদের মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করা হইতো। কিন্তু কারখানা বন্ধ থাকায় গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে ফলে এর প্রভাব পড়েছে বাজারেও। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিসিআইসির ডিলাররা।
অপরদিকে জেএফসিএল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন এর সাবেক সাধারন সম্পাদক মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন, শ্রমিক নেতা মোঃ জাহিদুর রহমান জানান, কারখানা বন্ধ থাকায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কারখানা সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে তারাকান্দির পরিবহন শ্রমিক নেতা মাসুদ আলী জানান- কারখানা এলাকায় প্রায় ৬শ ট্রাক আছে, প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ শ ট্রাকে সার পরিবহন করা হয়ে থাকে। কারখানা বন্ধ থাকার কারণে পরিবহন সংশ্লিষ্ট ট্রাকের চালক-হেলপার,ট্রাক মালিকরাসহ আরো প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
এদিকে জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল জেলা এবং উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলাসহ, মোট ১৯ জেলায় এ কারখানার আওতাধীন উৎপাদিত যমুনা দানাদার ইউরিয়া সার সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এবার জামালপুরসহ দেশের উত্তরাঞ্চল জেলা গুলো মধ্যে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক। তাদের ক্ষতি পুশিয়ে নিতে পানি নামার সাথে সাথেই বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তাই কৃষকরা চাহিদা অনুযায়ী সার না পেলে তাদের ফসল উৎপাদন ব্যাহতের আশঙ্কা রয়েছে। অপরদিকে দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকায় আগামি ইরি-বোরো মৌসুমে সার সংকট দেখা দিতে পারে,এমন হতাশা ব্যক্ত করেছেন বিসিআইসির ডিলাররাসহ অনেকেই।
কারখানা সুত্রে জানাযায়, যমুনা সার কারখানাটি ১৯৯১ইং সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে সার উৎপাদনে যায়। তখন থেকেই ১হাজার ৭ শত মেঃ টন ইউরিয়া সার উৎপাদন হয়ে আসছিল। কিন্তু যন্ত্রপাতি পুরনো হওয়া এবং চাহিদার তোলনায় তিতাসগ্যাস সরবরাহ না থাকার কারণে গড়ে সার উৎপাদন নেমে এসেছিল ১ হাজার ৬শত মেঃ টনে। সে হিসাব অনুযায়ী গত ৯ মাসে সার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৩২ হাজার মেঃ টন। এসব সারের চাহিদা পুরণের জন্য সরকারী ভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৮ মেঃ টন ইউরিয়া সার।
সরেজমিনে দেখাগেছে, কারখানা বাল্ক স্টোরে সারের বস্তা রাখার কোন প্রকার নিয়ম না থাকলেও বাল্ক স্টোরে ১২৭ মেঃ টন গুটি ইউরিয়া রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কারখানায় দুটি মাত্র গুদামে রয়েছে। গুদাম দুইটিতে ১২ হাজার মেঃ টন সার মজুদ রাখা সম্ভব হয়েছে। অবশিষ্ট আমদানি করা ২৮ হাজার ৮১ মেঃ টন ইউরিয়া সার মূল কারখানার ভেতরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে রাস্তায়, খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে। খোলা আকাশের নীচে রাখা বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া সার রোদ পুড়ে বৃৃষ্টিতে ভিজে গলে জমাট বেঁধে নষ্ট হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিসিআইসির ডিলার আবুল হোসেন সরকার বলেন বিদেশ থেকে আমদানি করা সার তোলনা মুলক ভাবে মানহীন এবং নি¤œমানের। এই সার ব্যবহার করে কৃষকরা আশানুরূপ ফসল না হওয়ায় সার নিতে চরম অনীহা প্রকাশ করেন কৃষকরা। ট্রাক ও ট্যাংক লরি মালিক সমিতি তারাকান্দি শাখার সভাপতি আশরাফুল আলম মানিক বলেন,‘আমদানীকৃত ইউরিয়া সারের মান অত্যন্ত খারাপ। ট্রাকে তোলার সময় অনেক বস্তা থেকে পানি ঝরে। সার ডিলারদের গুদামে নিয়ে গেলে তারা নিতে চান না।
এ সংক্রান্ত বিষয়ে যমুনা সার কারখানার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) ওয়ায়েছুর রহমান এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাহিদানুযায়ী ইউরিয়া সার মজুদ রয়েছে। ফলে কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়া সার নিয়ে কোন সংকট হবে না। তিনি আরও বলেন, টানা কয়েক মাস সার রাখা হলে নিচের কিছু বস্তা নষ্ট হতে পারে। তবে সার জমাট বেঁধে গেলেও এর গুণগত মান নষ্ট হয় না বলে জানান,।
এ বিষয়ে কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান জাভেদ আনোয়ারের কাছে কারখানা চালু করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন,সার কারখানা স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান জাপানের মিট সু বিসি হ্যাপি ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশন। সেই মিতসুবিশি কোম্পনীর সঙ্গে বিসিআইসির যোগাযোগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। স্টার্ট অফ হিটারটি তৈরীর জন্য প্রতিষ্ঠানটি ফেব্রিকেশনের কাজ করছে। বিশেষজ্ঞ দলের একটি টিম সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আসার কথা রয়েছে এবং অক্টোবরে আরও একটি দল স্টাট অফ হিাটরসহ অন্যান্য যন্ত্রংশ নিয়ে কারখানা আসবেন। নভেম্বরে মেরামতের কাজ শেষ হলে ডিসেম্বরে কারখানা সার উৎপাদনে যাবে বলে আশা প্রকাশ করছেন তিনি।