রাজধানীতে দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোনোর আগেই কিশোরদের একটা অংশের বেপরোয়া আচরণ এখন পাড়া মহল্লায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে আদনান কবির নামে এক কিশোরকে হত্যার পর এই ‘গ্যাং কালচারের’ বিষয়টি সামনে আসে। এরপর এসব গ্রুপের ব্যাপ্তি বেড়েছে। ১৫-২০ বছর বয়সী কিশোরদের প্রতিটি গ্রুপে ১০ থেকে ২০ জন করে সদস্য থাকে। তবে এখন শুধু ঢাকায় নয়, গ্যাং কালচার চালু হয়েছে দেশের আনাচে-কানোচেও।
মূলত কিশোর বয়সে একটা ‘নায়কোচিত’ চিন্তা-ভাবনা থেকেই গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে রাজধানীসহ সারাদেশে। দিনকে দিন আশঙ্কাজনক হারে দেশজুড়ে- হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে এসব উঠতি বয়সীরা। কিশোর অপরাধের নৃশংসতার মাত্রা তাদের মূল্যবোধ ও মানবিকতাবোধকে নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। প্রতিটি এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠছে আলাদা আলাদা কিশোর গ্যাং। কোনো কোনো এলাকায় একাধিক গ্রুপ গড়ে উঠেছে।
শুধু তাই নয়, নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা স্ট্যাটাস দেয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমোতে তারা একে অপরের সঙ্গে ভাববিনিময় করে। রাজধানীতে এ ধরনের শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশত খবর অনুযায়ী, গত তিন বছরে কিশোর গ্যাংয়ের প্রায় ৪শ’ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এর মধ্যে চলতি বছর ১৮৫ জন এবং গত দুই বছরে ১৯০ জন কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেফতার করে তারা। ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দে ৮৬টি খু’নের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া সর্বশেষ রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে ১১০ জনকে আটক করে পুলিশ। যার মধ্যে ১০৩ জনের আগের কোনো অভিযোগ না থাকায় তাদেরকে সতর্ক করে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, বাকি ৭ জনকে ছাড়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে আগের মামলা থাকায়।
কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা আগেও ছিল, এখনো আছে। আগে তারা বখাটেপনা বা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করত। এখন হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর বড় কারণ পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা। আগে গ্রামের মুরুব্বিদের সবাই ভয় পেত। এখন নগরায়নের ফলে মুরুব্বিদের কিশোররা ভয় পায় না, উল্টো মুরুব্বিরাই তাদের ভয় পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। তারা এখানে খুব একটা মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। পাশাপাশি পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় কিশোরদের হাতে এখন মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট। তারা ইন্টারনেটে মারামারির গেম খেলছে, হরর ফিল্ম দেখছে, এগুলো তাদের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ঢাকা শহরে গ্যাং কালচার বলতে কিছু থাকবে না। কিশোর গ্যাং বলি আর বড় গ্যাং বলি, গ্যাং বলে কোনো শব্দ থাকবে না। গাং চক্রকে নিশ্চিহ্ন করা হবে। গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে ডিএমপি শূন্য সহিষ্ণু (জিরো টলারেন্স) নীতি অবলম্বন করেছে। ঢাকায় কোনো গ্যাং থাকবে না। -এটি আশার কথা। যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে খুবই ভালো। তবে কিশোর-তরুণদের এই ভয়ঙ্কর গ্যাং কালচার বন্ধ করতে শুধু প্রশাসনের একক প্রচেষ্টা থাকলে চলবে না। সন্তানরা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে মিশছে এগুলো অভিভাবকদের দেখার দায়িত্ব। ব্যস্ত জীবনে অভিভাবকরা সময় না পাওয়ার অজুহাতে সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।