রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তহমিদা খানমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নিজ স্বার্থে মৃতপ্রায় এনজিওকে সক্রিয় দেখানো, এনজিও পরিচালকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে অর্থ আদায়, প্রশিক্ষণার্থীসহ অফিস স্টাফদের সাথে দুর্ব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি ‘কিশোর কিশোরী ক্লাব স্থাপন’ প্রকল্পের নিয়োগ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণাসহ ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদে আবেদনে উৎসাহিত করায় বেশ আলোচিত হয়েছেন এই কর্মকর্তা।
খোদ বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এই মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কর্মকা-ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকায় উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন তিনি।
তবে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবী করলেও দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন কর্তৃপক্ষ রাখলে আমি কি করব। গত ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর বালিয়াকান্দি উপজেলায় যোগদান করেন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তহমিদা খানম।
উপজেলার সরকারী কর্মকর্তা ও এনজিও প্রধানরা বলছেন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার খুঁটির জোর কোথায় যে তিনি একই কর্মস্থলে ১২ বছর রয়েছেন অথচ উর্দ্বতন কর্মকর্তারা কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছেন না।
মহিলা বিষয়ক অফিস সূত্রে জানা যায়, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ‘কিশোর কিশোরী ক্লাব স্থাপন’ প্রকল্পে দৈনিক ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে প্রকল্প চলাকালীন সময়ের জন্য শর্ত স্বাপেক্ষে ৩টি পদে ৯৭৬৬ জনকে নিয়োগের লক্ষ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। এরই অংশ হিসেবে বালিয়াকান্দি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে চাকরী প্রার্থীরা আবেদন জমা দেন। আবেদনের শেষ তারিখ ২৩ আগস্ট ২০১৯। আবেদনের শেষ সময় পর্যন্ত বালিয়াকান্দি উপজেলায় জেন্ডার প্রমোটার পদে ৩৮ জন, আবৃত্তি বিভাগে ৯ জন এবং সংগীত বিষয়ে ৫ জনের আবেদন জমা পরে।
পরবর্তীতে ৩রা সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইশরাত জাহান, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তহমিদা খানম ও উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সংগীত শিক্ষক নারায়ন দেবনাথ এর নিয়োগ বোর্ডে নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পরেও তিনি পূর্বে আবেদন বর্হিভুত নতুন করে ১৪ জন নিয়োগপ্রত্যাশীকে নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে কাগজপত্র জমা নিয়ে পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগাযোগ না করায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া।
উপজেলা সকল এনজিও পরিচালক ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক সমিতি রেজিষ্ট্রেশনে ১০-১৫ হাজার টাকা করে নেন, বাৎসরিক সরকারী অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে এনজিও পরিচালকদের থেকে প্রদত্ত অর্থের ১০% গ্রহণ, অফিসে বসে এনজিও পরিদর্শনে ৫ শত-১ হাজার টাকা, জেলা কর্তৃক এনজিও কমিটি অনুমোদনে ৫ শত টাকা। এসব চাহিদা পূরনে কোন এনজিও ব্যর্থ হলে অনুদান থেকে বঞ্চিতসহ কমিটি অনুমোদনে হয়রানী হতে হয়। এছাড়াও সামান্য কারণে এনজিও পরিচালক, অফিস স্টাফদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন। সরকারি দিবসগুলো সঠিকভাবে পালন না করে ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ভিজিডি সঞ্চয় ফেরত নিতেও তাকে উৎকোচ দিতে হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে মাতৃত্বভাতা প্রশিক্ষণে অনুপস্থিত নারীদের উপস্থিত দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে নিয়মিত অফিস না করা, অফিসে আসা বিভিন্ন প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে এনজিও কর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
নির্মল সাংস্কৃতিক একাডেমি উত্তম কুমার গোস্বামী, উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি তবলা প্রশিক্ষক উত্তম কুমার দাস জানান, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তহমিদা খানম গত বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) আমাদের মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে উপজেলার ৭ ইউনিয়ন থেকে আবৃত্তি এবং সংগীত বিষয়ে ২টি পদে পারদর্শী ১৪ জনের নাম, মোবাইল নম্বরসহ জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে অনুরোধ করেন।
আমরা উপজেলার একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার অনুরোধ রাখতে ওই দিনই ২টি পদের ১৪ জনের নাম ও মোবাইল নম্বরসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তার অফিসে জমা দিতে গিয়ে তার অফিসে কয়েকজনকে ব্যক্তিগতভাবে নিয়োগ পরীক্ষা নিতে দেখি। আমরা বিভিন্ন পরীক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তারপরদিন শুক্রবারে তিনি অফিসে এসে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছেন। আমরা জানতাম না ইতোপূর্বে নিয়োগ কমিটি নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন। এখন আমাদের প্রশ্ন তাহলে কোন স্বার্থে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আমাদেরকে দিয়ে এই নামগুলো সংগ্রহ করালো ? তাদের অভিযোগ তিনি মোটা অংকের টাকা পাওয়ার লোভেই নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পরেও নতুন করে চাকরীপ্রার্থী খুঁজেছেন।
নাম প্রকাশ না করার সর্ত্বে একাধিক নিয়োগ পরীক্ষার্থী জানান, বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ না থাকায় উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ এবং ইচ্ছামত কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন আমাদের। পরবর্তীতে নিয়োগ বোর্ডে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ বলে আমাদেরকে হেয় করেছেন তিনি। তাদের ক্ষোভ আমরা তো আবেদনই করব না সে কোরাম পূরণের জন্য সবাইকে চাকরীর আশ্বাস দিয়ে আবেদন করিয়েছেন।
মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার রুঢ় আচরণ এবং সমিতি রেজিষ্ট্রেশন হারানোর ভয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পায় এনজিও পরিচালকরা। একাধিক এনজিও পরিচালক নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, তার অধীনে ১০-১২টি এনজিও নিবন্ধিত রয়েছে।
দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকায় দিন দিন তার টাকার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার অফিসে গেলেই তিনি গিফটের কথা বলেন, সমিতি রেজিষ্ট্রেশনে আগে ১০ হাজার নিলেও এখন ১৫ হাজার টাকা নেন; বাৎসরিক অনুদানে চেক ইস্যু হওয়ার পরই উর্দ্বতন কর্মকর্তাকে গিফট দিবে বলে ১০% টাকা নেন, এনজিও কমিটি অনুমোদনে ৫ শত টাকা দিতে হয় তাকে। অফিসে বসেই তিনি পরিদর্শন কার্যক্রম সম্পন্ন করেন টাকার বিনিময়ে বলেও জানান তারা। তবে কিছু কিছু এনজিও পরিচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অধিকাংশ এনজিও’র কোন কাজ নেই, প্রকল্প নেই আবার কিছু এনজিও আছে সাইনবোর্ড নেই অথচ মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা টাকার জন্য এসব এনজিও সক্রিয় দেখাচ্ছেন তার স্বার্থ হাচিলের জন্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কম্পিউটার ব্যবসায়ী জানান, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ঘসা-মাজা কিংবা যেমন-তেমন অভিজ্ঞতা সনদ বানিয়ে দেয়ার জন্য কয়েকদিন আগে অনুরোধ করেছিলেন। বভিন্ন সময়ে তিনি কয়েকজন প্রার্থীকে আমাদের দোকানেও পাঠান আমরা অনৈতিক বলে কাজটি করিনি।
নিয়োগ পরীক্ষা এবং পরবর্তীতে আবেদন জমা নেয়া প্রসঙ্গে রোববার দুপুরে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার অফিসে গেলে তিনি তার স্টাফদের সাথে ডাক চিৎকার করে বিব্রত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। এ সময় তার সামনেই অফিসের কর্মচারী শামিমা বেগম বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) নিয়োগ পরীক্ষা মহিলা বিষয়ক অফিসে নেয়ার কথা স্বীকার করেও পরে চুপসে যায়।
আর্থিক দুর্নীতি, নিয়োগ পরীক্ষা ও একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন থাকার বিষয়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তহমিদা খানম জানান, কর্তৃপক্ষ রাখলে আমি কি করব তবে আর্থিক দুর্নীতির বিষয়ে তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন সুনামের সাথে বালিয়াকান্দি উপজেলা ছাড়াও অন্য উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্বপালন করছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইশরাত জাহান বলেন, ৩ সেপ্টেম্বর ‘কিশোর কিশোরী ক্লাব স্থাপন’ প্রকল্পের নিয়োগ পরীক্ষা বিধি মোতাবেক সম্পন্ন হয়েছে। ১টি পদে চাকরী প্রার্থী পূরণ হয়নি, এখানে নতুন যোগ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে নিয়োগ সংশ্লিষ্ট সকল কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা যদি এমন অনৈতিক কাজ করে থাকেন তাহলে অন্যায় করেছেন, বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। উনি দীর্ঘদিন যাবত একই কর্মস্থলে আছেন কিভাবে সেটা সংশ্লিষ্ট উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত।
বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাঠ পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা ৩ বছরের বেশি একই কর্মস্থলে থাকতে পারবেন না অথচ মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তহমিদা খানম ১ যুগ সময় ধরে বালিয়াকান্দিতে কর্মরত আছেন। তিনি টাকা ছাড়া কোন কাজ করেন না বলে প্রতিনিয়ত তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে আমার কাছে। আশা করব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে।
জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নূরে সফুরা ফেরদৌস বলেন, একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন থাকার নিয়ম নেই তবে কে কোথায় কখন যোগদান করেছেন বা কতদিন আছেন সেটা উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষ জানেন। তারাই বিষয়টি দেখবে আর আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন-১) রেজিনা আরজু একই কর্মস্থলে ১ যুগ থাকার বিষয়টি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আমি সদ্য যোগদান করেছি তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাচ্ছি না আপনি মহাপরিচালক মহোদয়ের সাথে কথা বলেন। তবে তার দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকার বিষয়টি দেখব।
এ বিষয়ে মহিলা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) বদরুননেছার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি এখনি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। একই কর্মস্থানে কিভাবে একজন কর্মকর্তা ১২ বছর থাকেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।