তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া। তার শ্রেণিতে ১৩ শিক্ষার্থী থাকলেও দুইদিন ধরে একাই ক্লাস করছে। শহর ঘেষা পটুয়াখালীর কলাপাড়ার বাদুরতলী (২) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এ চিত্রের ঠিক উল্টো দৃশ্য চরচাপলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ৬৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ৫৩ জন। এ কারণে এক বেঞ্চে তিন-চারজন করে বসতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের।
গত ২৮ আগস্ট দুই বিদ্যালয়ের এ বিপরীত চিত্র দেখা যায়। এ অবস্থা কলাপাড়ার অধিকাংশ বিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীর বিপরীতে কোথাও অতিরিক্ত শিক্ষক, কোথাও শিক্ষক সংকটে দিশেহারা শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাঠদানে হিমশিম খাচ্ছে। শিক্ষা অফিসের সঠিক তদারকির অভাব ও শিক্ষক পদায়নে বানিজ্যের কারণে উপকূলীয় উপজেলা কলাপাড়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কলাপাড়া শহর ঘেষা কলাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সাত জন। অথচ এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মাত্র ১১২ জন। ১৬ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক। বাদুরতলী (২) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পাঁচজন। এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৮৩ জন। প্রতি ১৬ দশমিক ছয়জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক। ইটবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছয়জন। এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ১২০ জন। ২০জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক। গিলাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক তিনজন। এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ১৭১ জন। ৫৭ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক একজন। হাসেম আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক চারজন। এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ১৩৮ জন। ৩৪ দশমিক পাঁচজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক। চরচাপলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পাঁচজন। এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৪২৯ জন। প্রতি ৮৫ দশমিক আটজন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক।
শহর কেন্দ্রিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের বিপরীতে শিক্ষক বেশি থাকলেও ঠিক উল্টো গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা অফিসকে ম্যানেজ করে গ্রামের বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শহরমুখী হওয়ায় গ্রামীন বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের শূণ্যপদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়লেও শিক্ষা অফিস এ ব্যাপারে নীরব।
গিলাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জুলফিকার আলী জানান, তারঁ বিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষক থাকলেও একজন মেডিকেল নিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে ছুটিতে। অপর শিক্ষক রাকিবুল আহসানকে ডেপুটেশনে হাসেম আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদায়ন করায় শিক্ষক সংকটে বিদ্যালয়ের ১৭১ শিক্ষার্থীকে পাঠদানে হিমশিম খেতে হচ্ছে তিন শিক্ষককে। চরচাপলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. নুরুন্নবী জানান, ৪২৯ জন শিক্ষার্থী। অথচ তারা মাত্র পাঁচজন শিক্ষক। বিদ্যালয়ে দুটি শিক্ষকের পদ শূণ্য থাকলেও পদায়ন না করায় শিক্ষার্থীদের পাঠদানে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ৪০জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও তবে বিপরীত চিত্রের বিদ্যালয় ইটবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহজাহান জানান, তাদের ছয়জন শিক্ষকের মধ্যে একজনকে ডেপুটেশনে নেয়া হয়েছে। পাঁচজন শিক্ষক এখন ১২০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন। কলাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ে শিক্ষক সাত জন। তবে শিক্ষার্থী প্রাক প্রাথমিক বাদে ৯৩ জন। গত ২২ আগস্ট এ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় শিক্ষার্থী উপস্থিত ৮০ জন। বাদুরতলী(২) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত ২৮ আগস্ট পঞ্চম শ্রেণিতে উপস্থিত পাওয়া গেছে পঞ্চম শ্রেণিতে আট জন, চতুর্থ শ্রেণিতে চার জন ও তৃতীয় শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থী কাগজে-কলমে এ তিন শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ৩৭ জন। পাঁচজন শিক্ষকের মধ্যে প্রধান শিক্ষক ফরিদা পারভীন ওইদিন ছুটিতে থাকলেও চার শিক্ষক ক্লাস নিয়েছেন ১৩ শিক্ষার্থীর। উত্তর পূর্ব চালিতাবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুদ্দিন মাহমুদ জানান, বিদ্যালয়ে ছয় শিক্ষকের বিপরীতে পদায়ন আছে তিনজন। এ কারণে ১৩১ শিক্ষার্থীকে পাঠদানে সমস্যা হচ্ছে। সোমবার এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলো ১০৮ জন।
এ ব্যাপারে একাধিক শিক্ষক নামপ্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন, শিক্ষা অফিসকে ম্যানেজ করলেই পছন্দের স্কুলে পোষ্টিং নেয়া যায়। শিক্ষার্থী না থাকলেও শিক্ষকের অভাব নেই অনেক স্কুলে। অথচ ওইসব স্কুলে যেমন ফলাফল খারাপ, তেমনি ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত কম। এ অবস্থা বছরের পর বছর চললেও সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঠিক তদারকি না থাকায় গ্রাম পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা এখন লেজেগোবড়ে।
চর চাপলী গ্রামের একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করেন, এক ক্লাসে এত শিক্ষার্থ যে তারা একসাথে কথা বললে অনেক দূর থেকে শোনা যায়। শিক্ষকদের পাঠদান করাতে সমস্যা হয়। অনেক সময় স্কুলে শিক্ষকরা সঠিক ভাবে পাঠদান করালেও বাসায় গিয়ে শিক্ষার্থীরা কিছুই মনে রাখতে পারছে না। তাদের দাবি, অন্তত নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী এক শ্রেণিতে থাকলে শিক্ষকদের পাঠদানেও যেমন সুবিধা হয়, শিক্ষার্থীরাও মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারে।
এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবুল বাসার বলেন, কোন কোন বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে। তবে শিক্ষক পদায়নে তাঁরা কোন পক্ষপাতিত্ব করছেন না। শিক্ষার্থী অনুপাতেই শিক্ষক পদায়ন করা হয়েছে। তবে যে সব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপাতে অতিরিক্ত শিক্ষক রয়েছে, তাদের যেখানে শিক্ষক সংকট রয়েছে সেই বিদ্যালয়ে পদায়ন করা হবে।