ভ্রাম্যমান মৌচাষী হাজী আইয়ুব আলী (৬৫) দীর্ঘ ৪০ বছর মৌচাষ জীবনে খুজে পেয়েছেন সফলতা। সৃষ্টি করেছেন আরো নিত্য নতুন মৌচাষী। তার হাত ধরে সাতক্ষীরা জেলাতেই ১৫০ এর অধিক চাষী মৌচাষে ঝুকে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাষ করছেন আরো ৫শ অধিক মৌচাষী। এ মৌচাষী ১ বছরে ২৫ টন পর্যন্ত মধু উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। সফলতার শীর্ষে অবস্থান করতে আইয়ুব আলীকে কায়িক পরিশ্রমের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে প্রতিকূল পরিবেশেও। আজ সফলতার শীর্ষে এসে তার একটাই দাবী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অত্যন্ত লাভজনক এ চাষকে গতিশীল করতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎপাদিত মধুর বাজার দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে রপ্তানী হলেও কিছু অসাধু চক্রের রোষানলে লাভজনক এ ব্যবসা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। মধুতে নানা ভেজাল ও অপদ্রব্য মিশ্রিত থাকায় বিদেশের বাজার থেকে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে ভ্রাম্যমান এ মৌচাষীর দেখা মেলে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা থানার ছোট কাশিপুর গ্রামের একটি আম বাগানে। এ আমবাগানে চৌহদ্দিতে মাইলের পর মাইল মাঠ জুড়ে মিষ্টি কুলের বাগানের সবুজ সমারোহ। কুল গাছের কচি পাতার সাথে এসেছে হালকা সবুজ রঙের ফুল। আর এ ফুলকে ঘিরেই মৌচাষী আইয়ুব আলী এ এলাকায় আস্তনা গড়েছেন। ১৫০টি বক্স নিয়ে চলতি কুলের ফুল মৌসুমে ১৮০০ কেজি মধু উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে বক্স ও বক্সের মৌমাছিদের পরিচর্যা করছেন। এর আগে তিনি লিচুর মৌসুমে দিনাজপুর ও গাজীপুর এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ মধু আহরণ করেছেন। তার উৎপাদিত মধু দেশের বিভিন্ন কোম্পানীর সাথে চুক্তির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া নিজেই ম্যাগ নামের একটি কোম্পানি খুলে শতভাগ খাঁটি মধু সরবরাহ করছে সারা দেশে। অত্র অঞ্চালের কুল চাষী আবদুর রাজ্জাক, আবদুল কাদের, শেখ মঞ্জুরুল ইসলামসহ একাধিক কৃষক এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, কুল বাগান ঘিরে মৌমাছির মধু আহরণে কুলের উৎপাদনও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কেননা পরাগায়নে মৌমাছির ভূমিকা খুবই গুরত্বপুর্ন। কেবলমাত্র হাজী আইয়ুব আলী নয়, কুল অধ্যুষিত পাটকেলঘাটার বিভিন্ন মাঠে আরো অনেক ভ্রাম্যমান মৌচাষী আখড়া করেছে। মৌচাষী আইয়ুব আলীর সফলতার গল্প জানতে গিয়ে অনেকটাই বিস্মিত হতে হয়েছে। দিনমজুর পরিবারের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনী উপজেলার বুধহাটা ইউনিয়নের কুলটা গ্রামে তার জন্ম। সপ্তম শ্রেণীতে পড়-য়া অবস্থায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পে একটি ৭ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তার এ মৌচাষ জীবনে প্রবেশ ঘটে। এপিচ শেরিনা/ইন্ডিকা জাতের দেশীয় মৌমাছি দিয়ে প্রথম অবস্থায় তার মৌচাষ শুরু হয়। পরবর্তীতে এপিচ ম্যালিফেরা জাতের মৌমাছি দিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৌচাষ গড়ে তোলেন। একটি বক্সে রানী সংরক্ষণ ও মধু আহরণের মৌমাছি স্থাপনে প্রায় ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। একটি বক্স থেকে গড় ৪৫ থেকে ৫৫ কেজি মধু বছরের (৪টি মৌসুম) সরিষা, আম, লিচু, তিল, ধনিচা, কুল এ ছাড়া বাকী সময় সুন্দরবন ঘুরে আহরণ করা যায়। তার উৎপাদিত মধুর বাজার দর কেজি প্রতি ৬ শত টাকা। ১৫০ টি বক্সের পিছনে ৩ জন শ্রমিক মাসিক ৩৩ হাজার টাকা বেতনে শ্রম দিয়ে থাকে। ১ বছরে ৪০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার মধু উৎপাদনে শ্রমিক বাবদ খরচ ৩ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া রানী সংরক্ষণ, পরিবহন ব্যবস্থা ও রানী মৌমাছি উৎপাদন খরচ মিলিয়ে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা খরচ হয়। ১ বছরে ১৫০ টি বক্স হতে আইয়ুব আলীর লাভ হচ্ছে প্রায় ৩২ লক্ষ টাকা। অনুসন্ধানের সময় তালা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দিলীপ ঘোষ এ প্রতিবেদককে জানান, মৌচাষী আইয়ুব আলীর সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়। সে সুবাদে তালা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর কুলের আবাদ হওয়ায় তাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছেন তিনি। যেন তার এ মৌচাষ দেখে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরী হয়। সাথে অত্র এলাকার কুলের ফলন বৃদ্ধি পায় এমনটাই তার উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি সাতক্ষীরা জেলার কৃষিবিদ নুরুল হক এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সরিষার মৌসুমে মৌচাষীদের বক্স ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করা হয়। কুলের মৌসুমে এ চাষের প্রসার বেড়েছে এটা তার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে মৌচাষী ও কুলচাষী উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ প্রদান করা হবে।