শীত মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য এখন জেলে পল্লীগুলোতে ব্যাপক প্রস্ততি চলছে। আর কয়েক দিন পরে জেলেরা পাড়ি জমাবে সাগর উপকূলে। শেষ মূহুর্তে কর্মব্যস্ত জেলে পল্লীর মানুষরা। এত করে জেলা পল্লীতে নতুন ট্রলার তৈরি, পুরাতনটা মেরামত, জাল বুনা ও শুকানোর ধূম পড়ে গেছে। সুন্দরবন ঘেরা সাগরে মাছ ধরার উপর বিরাজ করছে তাদের সারা বছরের জীবিকা। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া, হিতামপুর, মাহমুদকাটী, নোয়াকাটি, কপিলমুনি, কাটিপাড়া, রাড়-লী, শাহাপাড়া, বাঁকা সহ বিভিন্ন গ্রামের জেলে পল্লী থেকে প্রায় ২৫০টি ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন ট্রালার তৈরি, পুরাতন ট্রলারগুলো সংস্কার, জালবুনা, কাঠের নোঙ্গর (গ্রাফি), ট্রলারের রং করা, জালে গাব ফলের রস লাগানো সহ সমুদ্রে যাওয়ার পস্তুতি নিয়ে জেলে পল্লীর নারী-পুরুষরা শেষ মূহুর্তের কর্মব্যস্ত দিন কাঁটাচ্ছে।
উপজেলার বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, জেলেরা কপোতাক্ষ নদের তীর বোয়ালিয়া ব্রিজের দুই পাশে নতুন ট্রলার তৈরি পাশাপশি পুরাতন ট্রলার মেরামতের কাজ করাছেন। শংকর বিশ্বাস ও রবীন বিশ্বাস এফএনএসকে জানান, তারা নতুন ১টি করে ট্রলার তৈরি করছেন। নতুন ট্রলার তৈরী করতে সর্বমোট খরচ পড়ছে ৫ লাখ টাকা। ৬০ ফুট লম্বা ১৭ ফুট চওড়া একটি ট্রলার তৈরি করতে প্রায় ৫শ সেফটি কাঠ লাগছে। সব কাট দিয়ে ট্রলার তৈরি হয় না। এলাকায় পাওয়া যায় এমন চম্বল, বাবলা, শিরিস, মেহগনী, খৈই কাঠ দিয়ে তারা ট্রলার তৈরি করছে। প্রতি সেফটি খৈ, বাবলা ও চম্বল কাঠ ৬শ টাকা থেকে ১৫শ টাকা দরে ক্রয় করেছেন। ট্রলার তৈরি করতে বিভিন্নস্থান থেকে মিস্ত্রী আনতে হয়। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি থানার ট্রলার মিস্ত্রী জাহাঙ্গীর আলম, শেখ মিরাজ হোসেন তাদের দুইটি দলে ৪ জন সহকারী মিস্ত্রী নিয়ে নতুন ট্রলার তৈরির কাজ করছেন। ফরিদপুর জেলার মিস্ত্রী অচিন্ত বিশ্বাস, প্রদীপ বিশ্বাস, রবিউল সহ ৪জন মিস্ত্রী দিয়ে নতুন ও পুরাতন ট্রলার মেরামত করা হচ্ছে। ট্রলার তৈরিতে মিস্ত্রীদের থাকা খাওয়া বাদে প্রতিটি নতুন ট্রলার তৈরী বাবদ মজুরী ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। নতুন ট্রলার তৈরির পর তাতে রং করতে প্রায় ১২টিন আলকাতরা লাগে। পুরাতন ট্রলার মেরামত করতে ২০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। একটি নতুন ট্রলারে প্রায় ৩ মন পেরেক, ১শ কেজি জলই (পাতাম) প্রয়োজন হয়। ট্রলার তৈরি পর ইঞ্জিন বসাতে প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি ট্রলারে জাল ধরার জন্য ২টি করে নোঙ্গর প্রয়োজন হয়। লোহার তৈরী নোঙ্গর তৈরী করতে খরচ পড়ে ২৮ হাজার টাকা আর কাঠের তৈরী নোঙ্গর তৈরী করতে খরচ পড়ে ৩ হাজার টাকা। প্রতিটি মাছ ধরার জাল তৈরি করতে তাদের খরচ হয় ৯০ হাজার থেকে ১লাখ টাকা।
সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য প্রতি ট্রলারে ২টি জাল প্রয়োজন হয়। প্রতি ট্রলারে জাল ধরার জন্য ৮ থেকে ১০ জন কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। তাদের থাকা খাওয়া বাদে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য ট্রলার প্রতি ৫-৬ মাসে সব কিছু মিলে খরচ পড়ে প্রায় ৮ লাখ টাকা। তারা আরো জানায়, মহাজনদের কাছ থেকে ৬ থেকে ৭ মাসের জন্য চড়া সুদে টাকা ধার নিলেও ১ বছরের হিসাবে টাকা দিতে হয়। প্রতি এক লাখ টাকায় মহাজনদের প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। জেলে পাড়ার অজয় বিশ্বাস এফএনএসকে জানান, মাছ ধরার জন্য সরকারি ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে তাদের কষ্টার্জিত টাকা ঘরে আসতো। তা না হলে মহাজনের চড়া সুদসহ আসল টাকা পরিশোধের পর অনেক সময় খালি হাতে ঘরে ফিরতে হয়।
অধিকাংশ জেলেরা বিভিন্ন মহাজনের অধীনে থেকে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। মহাজনরা জেলেদের পাস পার্মিট করে রাখে। দুবলার চরে রওনা দেওয়ার আগে মোংলা থেকে পাসপার্মিট নিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। এ বছর মোংলা হয়ে বলেশ্বর নদী দিয়ে দুবলার চরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে করে উপজেলার জেলেদের প্রায় ৩ দিন বাড়তি সময় লাগবে এবং খরচ বেড়ে যাবে দ্বিগুন। সব কিছু ঠিক থাকলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গা পূজা শেষে জেলেরা মাছ ধরার জন্য সুন্দরবনের দুর্বলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।
জানাগেছে, বন সুরক্ষার জন্য বনের ১৩টি চর নিয়ে জেলেরা যে মৎস্য পল্লী তৈরি করে, তা এ বছর সীমিত করা হতে পারে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ জানান, বঙ্গোপসাগর উপকূলে মাছ ধরার মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে বন বিভাগ সে মত তারা সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বোয়ালিয়া জেলে পল্লীর দিপংকর বিশ্বাস ও বিশ্বজিৎ বিশ্বাস এফএনএসকে জানান, দুর্গা পূজার পর উপজেলার সকল ট্রলার এক সঙ্গে রওনা দিবে। বাসা বাঁধবেন সুন্দরবনের দুবলার চরে। শুরু হবে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বনদস্যু ও জলদস্যুদের সাথে জেলেদের বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রাম। মাছ ধরার জন্য গভীর সমুদ্রে ভয়ংকর, বিক্ষুদ্ধ উত্তাল ঢেউয়ের সংগে যুদ্ধ করে জাল ফেলে মাছ ধরা। সমুদ্রে মাছ ধরা জেলে পল্লী মানুষের নেশা ও পেশা। জীবিকা অর্জনের সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া প্রতি মূহুর্তে লড়ায়ের এক প্রস্তুতি। সব মিলিয়ে জেলে পল্লীগুলোতে এখন চলছে সাগরে যাওয়ার মহাকর্মযজ্ঞ।