কিছুদিন আগে কর্মের বিশালতাকে একপাশে ঠেলে রেখে দেশের বাইরে গিয়েছিলাম স্ব-পরিবারে ঘুরতে। গিয়েছিলাম থাইল্যান্ড। আসা-যাওয়া মিলিয়ে দিন সাতেকের অবস্থিতি। আজকাল আমাদের দেশের লোকদের কাছে থাইল্যান্ড যাওয়া ডালভাতসম। সে যাই হউক ওখানকার কিছু অভিজ্ঞতার সাথে এখানকার কিছু বিষয়ের মিল-অমিল খুঁজতে গিয়েই এ লেখার অবতারণা, তবে ভ্রমনকাহিনী নয়।
এখানে বলে রাখা ভালো দেশ থেকে ট্র্যাভেল এজেন্ট-এর মাধ্যমে পরিবহন , হোটেল ও দর্শনীয় স্থানসমূহ ঠিক করে যাওয়াতে আরও কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি। এখন মনে হয় হলেই ভালো হতো, জানার পরিধি বাড়ত।
বিমানে (বাংলাদেশ বিমান নয়, কারন শুরুতেই ৯টার গাড়ি কয়টায় ছাড়ে, এবিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে চাইনি ) করে থাইল্যান্ড এর সুবর্ণভুমি বিমান বন্দরে বন্দরে গিয়ে নেমে মনে হোল বিমান বন্দর এর কর্মচারি-কর্মকর্তাগন তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটক যে তাদের জাতীয় আয়ের একটা বড় উৎস তা তারা জানে ও বোঝে।
সে যাই হউক বিশাল বিমান বন্দরের আভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে আরেকটি বিমানে চলে গেলাম ফুকেট, আমাদের প্রথম গন্তব্য। এরপর মাইক্রো বাসে করে নির্ধারিত হোটেলে যাবার সময় পথ পার্শ্বে চমকে দেখি লাল কৃষ্ণচূড়া, চমক আরও বাড়ে যখন একে একে দেখি বেগুনি জারুল ও হলুদ সোনালু ফুল। মনে হল দেশেই আছি। ফুকেটকে আরও আপন মনে হল। বিদেশে গেলে মনে হয় এরকমই হয়।
ওখানে দেখলাম যত রাতই হউক নিরাপদ বিদেশী পর্যটকগন, তাদের আয়ের উৎস যেহেতু এই অনন্যতাই। ফুকেট থেকে একদিন জাহাজে সমুদ্র ভেঙ্গে রওনা হলাম ফিফিদ্বীপ এর উদ্দ্যেশে। পথে দেখলাম একটা দ্বীপ দাঁড়িয়ে জুতা পরা পায়ের মত। দেখলাম জেমসবন্ড-এর সিনেমার শুটিং হয় যে স্থানে সেই পাহাড় ও বানর দল এর আকর্ষন নিয়ে দ্বীপ এর এক চিলতে মেরিনাবিচ। জাহাজ আরেকটা একটা দ্বীপের পাশে উদ্দেশ্য আগ্রহী পর্যটকগন পানিতে নেমে অদূরের ছোট্ট বিচে যাবে সাঁতার কেটে পানিতে মাছ দেখতে দেখতে। নিরাপত্তা মূলক লাইফ জ্যাকেট সহ ডুবুরির ড্রেস পড়ে যারা যাবার তারা গেল। ওখান থেকে, এক গ্রুপ চলে গেল আরেকটা দ্বীপ উদ্দেশ্য যেখানে রয়েছে স্কু বা ড্রাইভিং এর ব্যবস্থা। একটা সময় মধ্য দুপুরে পৌঁছালাম ফিফিদ্বীপে। নেমেই খেতে চললাম বিচ সংলগ্ন রেসটুরেন্টে। ছোট্ট একটু বিচ, ঢেউ তেমন নয়,মন ভরে না।
এরকম আমাদের দেশে আমরা জাহাজে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাই। চলতি পথে সমুদ্রের কি উদ্দামতা, কি বিশাল বিচ , সমুদ্রের ঢেউ মন ভরে যায়। অথচ প্রচার এবং আনন্দদায়ক ইভেন্ট-এর আয়োজনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আবার অসচেতনতার কারণে যত্রতত্র অপচনশীল ময়লা ফেলে নষ্ট করছি সেন্টমার্টিন-এর পরিবেশ।
ফুকেটে অনেক গুলো ছোট ছোট সি বিচ আছে। আমদের হোটেলের কাছে হাঁটা দূরত্বে একটি বিচ ছিলো। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কয়েকবার গিয়েছি। ঢেউ নাই বললেই চলে। সন্ধ্যা হওয়ার সংগেসংগে বীচে লাগানো লাইট জ্বলে উঠলো। বিচের একপাশে টুরিস্ট পুলিশ গাড়ি নিয়ে বসে আছে, যে কোন সমস্যার মোকাবেলায়। যে যার মত আনন্দ আহরণ করছে। তবে তেমন কোন বিদেশী পর্য্টক চোখে পড়লো না। পরের দিন আমাদের গাইড জানালো দ্বীপটির অন্য এলাকায় বিচ রয়েছে যেখনে স্থানীয়রা যায় না। বিদেশী পর্য্টকরা মূলতঃ ঐসব বিচে যায় এবং সানবাথ করে ও নিজেদের মত করে সময় কাটায়। যেখানেই যাই বিভিন্ন দেশের পর্যটক-এর ছড়াছড়ি তারা এসেছে, বিনোদনের জন্য। হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, পার্লার, ট্র্যাভেল এজেন্ট-এর ব্যবসা জমজমাট।
অথচ আমাদের কক্সবাজার-এর সমুদ্রসৈকত-এর ঢেউ প্রবল ও মনকাড়া , রয়েছে টানা সি বিচ। ইদানীং ভালো কিছু হোটেল গড়ে উঠলেও বিনোদন সুবিধা অপ্রতুল। সোনাদিয়ায় বিদেশীদের জন্য এক্সক্লুসিভ জোনের কথা আজ ৪০ বৎসরের উপর শুনে আসছি অথচ বাস্তবায়নের কোন হদিস নেই।
ফুকেট দেখতে গেলাম, এটা শোনাম ফুকেট ফ্যান্টাসি। বিশাল অব কাঠামোর হল, লোকে লোকারন্য। মুলতঃকাহিনীর মধ্যেদিয়েসার্কাস-এর এক পরিশীলিত রূপ উপস্থাপিত হয়। এ রকম শো আমাদের দেশেও গড়ে তোলা সম্ভব।
এরপর ব্যাংকক আসি। ওখানে গিয়েছি সাফারি পার্ক ও ব্যাংককের শহরের কোল ঘেষে বয়ে যাওয়া চাও ফারারা বা চাইও ফারা নদী; নৈশকালীন নৌ-বিহার। স্টিমার এগিয়ে চলছে আর আমরা গান শুনতে শুনতে ও নাচ দেখতে দেখতে ডিনার করছি আর দেখছি নদীটির দুই তীরের ঐতিহাসিক স্থাপনা যার মধ্যে রয়েছে রাজাদের বাড়ি, সমাধিস্থল ইত্যাদি, প্রত্যেক কাঠামোস্থলে আলোর ব্যবস্থা এমন ভাবে করা যাতে জাহাজ থেকে ঐ স্থাপনাসমূহ বাঁধাহীনভাবে দেখা যায়। অদ্ভুত সুন্দর। আমাদের রয়েছে বুড়িগঙ্গা যার দুই তীরে ঐতিহাসিক স্থাপনার অভাব নেই। আমরাও এরকম উদ্যোগ নিতে পারতাম।
অথচ আমরা কেমিক্যালযুক্ত বর্জ্য দিয়ে নদী দূষণ করছি, নদীর জায়গা দখল করে করে পর্যটক দূরে থাক দেশিয় লোকদের জন্যও ক্রমে বুড়িগঙ্গাকে করে তুলছি অগম্য।
সাফারি পার্কে পশুপাখি ও বিভিন্ন শো দেখে ফেরার সময় টুরিস্টগাইড আমাদের নিয়ে গেল গাড়ি চালিয়ে কাছ থেকে পশুদের আবার দেখার সুযোগ করে দিতে। জানা ছিলো না এ রকম ব্যবস্থাও রয়েছে। এটা উল্লেখ করলাম এজন্য যে তার সুযোগ ছিল আমাদের না দেখিয়ে চলে যাবার। কিন্তু সে তার দায়িত্ববোধ থেকে সরে আসেনি।
আমরা আর কত সময় নেবো চাহিদা মত অবকাঠামো ও বিনোদন পরিবেশ গড়ে তুলে বিদেশি পর্যটককে আমাদের দেশে বেশি বেশি করে আকর্ষন করার। আর কবে আমরা পরিচয় দেবো দায়িত্ববোধ-এর? আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে তুলে ধরে পর্যটন শিল্পকে প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমানের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার পাশাপাশি দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে পারবো।
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী : বেসরকারি ব্যাংক নির্বাহী এবং উপদেষ্টা সেভ দ্যা রোড