পঞ্চদশ শতাব্দীর রাজধানী খ্যাত শাহ মোহাম্মদাবাদে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর স্থাপনের দাবি উঠেছে। বর্তমানে এলাকার নাম বারোবাজার। বারোবাজারটি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। কালীগঞ্জ শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে আর যশোর জেলা শহর থেকে ১৭ মাইল উত্তরে অবস্থিত। ঢাকা খুলনা মহাসড়কের দুই ধারে শত শত পুকুর ও দিঘির স্বচ্ছ পানির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ আর বুড়ি ভৈরব নদীর তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘেরা আর ঐতিহাসিক মসজিদ পরিবেষ্টিত এই বারোবাজার। যতটুকু জানা যায়, বারোজন আউলিয়ার নামানুসারে এখানকার নামকরণ করা হয়। আউলিয়ারা হলেন এনায়েত খাঁ, আবদাল খাঁ, দৌলত খাঁ, রহমত খাঁ, শমসের খাঁ, মুরাদ খাঁ, হৈবত খাঁ, নিয়ামত খাঁ, সৈয়দ খাঁ, বেলায়েত খাঁ ও শাহাদত খাঁ।
এই বারোবাজারকে পর্যটন এলাকা ঘোষণা ও জাদুঘর স্থাপনের দাবিতে সম্প্রতি স্থানীয় কিছু ব্যক্তি সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার প্রচারনা, সংবাদ সম্মেলন, প্রচার প্রচারনাসহ নানা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠান্ডু তাদের এই দাবির সাথে একমত ঘোষণা করে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘বারোবাজার প্রচীন ঐতিহ্য রক্ষা আন্দোলন কমিটি’ নামের একটি গ্রুপের মাধ্যমে প্রচার প্রচারনা চালাচ্ছেন।
গ্রুপের এডমিন সনজিত কুমার দে জানান, কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার এলাকায় রাজ্য ছিল, রাজ সিংহাসনও ছিল। ছিল সুপ্রশপ্ত Í রাজ পথ আর শান বাধানো ঘাট, কালের চক্রে তা বিলীন হবার পথে। স্থানীয়দের দাবিতে ১৯৯০-৯২ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ এখানে প্রত্ননিদর্শন গুলি উদ্ধারের জন্য খনন কার্য পরিচালনা করে। সেই সময় বেশ কিছু মসজিদ, সেনা ছাউনি, সিড়ি, কবরস্থান, নদী বন্দর বা জাহাজ ঘাট আবিষ্কৃত হয়। আউলিয়াদের পূণ্যভূমি বারোবাজারে রয়েছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ গাজি কালু চম্পাবতীর মাজার। রয়েছে সুলতানী শাসন আমলের ১৯ টি মসজিদ। যা এতদিন মাটির নীচে ঢাকা ছিল। এখনো মাটির নীচে ঢাকা রয়েছে ৭টি মসজিদ। এ ছাড়া দিঘি রয়েছে ২০ টি। কিন্তু ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় ১২৬ টি দিঘি ছিল কিন্তু কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে। অনেক স্থান দখল হয়ে গেছে। প্রায় ১০ বর্গ মাইল এলাকাজুড়ে রয়েছে বহু অজানা প্রত্ন সম্পদে ভরপুর।সনজিত কুমার দে বলেন, বারোবাজারে প্রতিদিন শত শত লোক আসে পঞ্চদশ শতাব্দীর নিদর্শন মসজিদসহ আবিষ্কৃত স্থাপনা দেখতে। এই এলাকা এখন পর্যটন এলাকা ও প্রত্নতাত্তিক জাদুঘর স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশেষ করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম আর্কিটেকচারের শিক্ষার্থীরা এখানে আসে রিসার্চ করতে। তাদের প্রয়োজনে আমরা এলাকার মানুষদের নিয়ে সামাজিক আন্দোলন করছি। ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, এলাকার সুধীজন, সাংবাদিক ও শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।
বিলুপ্ত নগরী বারোবাজার বই এর লেখক ও গবেষক রবিউলি ইসলাম জানান, বারোবাজার এলাকা যদি পর্যটন এলাকা ও প্রত্নতাত্তিক জাদুঘর স্থাপন করা হয় তাহলে এলাকার আর্থ সামাজিক উন্নয়ন অনেক এগিয়ে যাবে। এলাকাবাসীর সময়ে দাবি বলে উল্লেখ করেন তিনি।কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠান্ডু জানান, বারো আওলিয়ার বারোবাজারে অনেক ঐতিহাসকি নিদর্শন রয়েছে। এখানে রয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দির অনেক মসজিদ, দীঘি, কবরস্থান, কালু-গাজী-চম্পাবতির মাজার। পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করবেন বলে যোগ করেন তিনি।ঝিনাইদহ-৪ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার জানান, বারোবাজার এলাকা প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনে ভরপুর। ১৯৯২ সালের দিকে প্রত্নত্ব¡ বিভাগ বেশ কিছু ঢিবি খুড়ে এই নিদর্শণ গুলো উদ্ধার করে। এলাকাবাসীর জোর দাবি এখানে পর্যটন এলাকা ্ও জাদুঘর স্থাপনের। তিনি বলেন, এই সংক্রান্ত তথ্য প্রমানাদি যদি আমার কাছে দেওয়া হয় তাহলে তিনি পর্যটন এলাকা ও জাদুঘর স্থাপনের জন্য মহান সংসদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করবেন। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, বঙ্গ বিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি নদীয়া দখলের পর নদীয়ার দক্ষিণ বা দক্ষিণ পূর্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে মনোযোগী না হয়ে উত্তর দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে তার বিজিত রাজ্য উত্তর দিকে প্রশন্ত হতে থাকে।
পরিশেষে সামছুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পৌত্র নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-১৬৬৮) সালে এর শাসনামলে যশোর ও খুলনার কিছুকিছু অংশ তার রাজ্যভুত হয়। ওই অঞ্চলে বিজয়ের গৌরব অর্জন করেন বৃহত্তম খুলনা জেলার বাগেরহাটের পরশমণি শ্রেষ্ঠ আওলিয়া হযরত খান জাহান আলী। তিনি ১৪৫৯ সালে (৮৬৩) হিজরী ২৩ অক্টোবর ইহধাম ত্যাগ করেন। তিনি একসময় নিজের আত্মরক্ষার্থে একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতগঞ্জ প্রবেশ করেন। সেখান থেকে বৃহত্তম যশোর জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার হাকিমপুর হয়ে বারবাজার অভিমুখে রওনা দেন। পথিমধ্যে জনসাধারনের পানীয় জলের তীব্র কষ্ট দেখে তিনি এ অঞ্চলে অগণিত দিঘি আর পুকুর খনন করেন। কথিত আছে, একই রাতে এসব জলাশয় খনন করা হয়েছিল। ফলে বারোবাজার অঞ্চলে ৮৪ একর পুকুর ও দীঘি এখনও বিদ্যমান।