লালমনিরহাটে গাড়ি-দোকানপাট ভাঙচুর, পুলিশকে মারধর ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিএনপি নেতকর্মীদের বিরুদ্ধে ৪০টির বেশি মামলাসহ রংপুর বিভাগের আট জেলায় মামলার ফাঁদে পড়েছে বিএনপি। নাশকতা পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গত পাঁচ বছরে পাঁচ শতাধিক মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে দ্রুত বিচার আইনে ২৭টিসহ রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলায় দায়ের করা এসব মামলায় ৫০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় এক হাজার জনকে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকেই এখন বাড়িছাড়া। এসব নেতাকর্মী প্রকাশ্যে দলীয় কর্মসূচিতেও অংশ নিতে পারছেন না।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট দেশব্যাপী টানা হরতাল ও অবরোধের ডাক দেয়। এ সময় হরতালের নামে নাশকতা সৃষ্টি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে বিএনপির এসব নেতাকর্মীর নামে মামলা করে পুলিশ।
এ ব্যাপারে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে জোর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তবে যারা গা-ঢাকা দিয়েছে তাদেরই গ্রেপ্তারে বিলম্ব হচ্ছে।
তিনি জানান, কোনো রাজনৈতিক হয়রানি নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই এসব মামলা হয়েছে। আন্দোলন ও হরতালের নামে যারা নাশকতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে তাদের বিরুদ্ধেই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, রংপুরে বিস্ফোরকসহ ২০০টির বেশি মামলা হয়েছে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আসামি করা হয় ৬০০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে শতাধিক। সম্প্রতি নাশকতার ১২ মামলায় আদালতে জামিন নিতে গিয়ে জেলহাজতে গেছেন জেলা বিএনপির সহ সভাপতি সামসুজ্জামান সামু, সাধারণ সম্পাদক রইস আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আনিছুল হক লাকু, জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সহিদুল ইসলাম বিপু, যুবদলের সভাপতি মাহফুজ-উন-নবী ডন, সাংগঠনিক সম্পাদক জহির আলম নয়নসহ বেশ কয়েকজন। বর্তমানে বিএনপির এসব নেতাকর্মীরা জামিনে রয়েছেন।
এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল ও ছাত্রদলের দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১০ থেকে ১৫টি করে মামলা রয়েছে। তাঁদের অনেকেই এখন রাতে গ্রেফতারের ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারেন না। অনেকে আত্মগোপনে আছেন গ্রেপ্তার আতঙ্কে।
ডিআইজি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাটে গাড়ি-দোকানপাট ভাঙচুর, পুলিশকে মারধর ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিএনপি নেতকর্মীদের বিরুদ্ধে ৪০টির বেশি মামলা করা হয়। এসব মামলায় বিএনপির পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও জেলায় হরতালে অরাজক পরিস্থিতি সৃৃষ্টির দায়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫০টিরও বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার ৩০০। এর মধ্যে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে ২৮ ফেব্রুয়ারি হরতালে সহিংসতার ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যু ঘটলে ৫২ জনের নাম উল্লেখসহ এক হাজার ৬০০ নেতাকর্মীকে আসামি করে ঠাকুরগাঁও থানায় মামলা করা হয়।
নীলফামারীতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা পাঁচটি মামলায় ১২২ জনের নাম উল্লেখসহ ২০০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো ২০টির বেশি মামলায় ৩০০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর, ফুলবাড়ী ও রাজীবপুর থানায় ৩০টির বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪০০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় অর্ধশতজনকে।
পঞ্চগড় সদর ও তেঁতুলিয়া থানায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলায় আসামি করা হয় দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে।
দিনাজপুর সদর থানায় দুটি মামলায় আসামি করা হয় ৮৭ নেতাকর্মীকে। এ ছাড়া আরো ৩০টি মামলায় দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
গাইবান্ধায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪০টির বেশি। এর মধ্যে পলাশবাড়ী থানায় পাঁচটি এবং সুন্দরগঞ্জ থানায় হয়েছে ৩৫টি। হরতালে অরাজকতা পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে করা এসব মামলায় এক হাজার ৬০০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়, যার মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ২০০ জনকে।
লালমনিরহাটের বিএনপি পক্ষের আইনজীবী এ্যাড. নজরুল ইসলাম ও স্বপন এবং রংপুরে আফতাব হোসেন ও সফি কামাল বলেন, গত পাঁচ বছরে রংপুর বিভাগের আট জেলায় পাঁচ শতাধিক মামলায় ৫০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে। তাঁরা সব নেতাকর্মীর মুক্তি এবং তাঁদের নামে মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানান।
এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বাবলা বলেন, মামলা, গ্রেপ্তার আর নির্যাতন করে আন্দোলনকে দমানো যাবে না।
বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকন ও লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, সরকারের ইন্ধনে পুলিশ অন্যায়ভাবে এসব মামলা করেছে। কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাসহ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং দায়ের করা সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও পালন করা হয়েছে। হরতালের দিন আমাদেরকে দলীয় কার্যালয় থেকে বের হতে দেওয়া হয় না, আমরা মিছিল-মিটিং করতে পারি না। অথচ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সাজানো মামলায় আমাদের জড়ানো হয়েছে। তবে মামলায় জড়িয়ে ও গ্রেপ্তার করে কখনো আন্দোলন থামানো যাবে না।