চট্টগ্রামের চকবাজারে বেসরকারি ছাত্রী হোস্টেলের ব্যবসা এখন বেশ জমজমাট। ছাত্রীরা চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজছাত্রী হোস্টেল অন্তত ৪ বছর ধরে বন্ধ থাকায় তিনগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে থাকতে হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন ছাত্রী নিবাসে। এতে পোয়াবারো অবস্থা উঠতি প্রাইভেট ছাত্রী নিবাসগুলোর। চকবাজারের আধা কিলোমিটার এলাকায়জুড়ে ছোট-বড় মিলে গড়ে উঠেছে অন্তত ১৫টি ছাত্রীনিবাস রয়েছে। এ নিবাসগুলোতে বসবাস প্রায় ১৫শ’ ছাত্রীর। দুর-দূরান্ত থেকে আসা ছাত্রীরাও কোন উপায় না দেখে বেশি টাকার বিনিময়ে বাস করে ওই ছাত্রী নিবাসগুলোতে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজি মোহাম্মদ মহসিন কলেজের ছাত্রীরা এসব ছাত্রী নিবাসে বসবাস করেন। নগরীর চকবাজার এলাকাটি শিক্ষার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দুটি সরকারি কলেজের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও বিসিএস, ব্যাংক জব কোচিং সেন্টার আছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পড়ালেখা করে আনুমানিক এক লাখ ছাত্রী। ভালো পড়ালেখা ও চাকরির জন্য এই নারীরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিবার ছেড়ে এখানে বসবাস করছেন। শহরের চকবাজার এলাকায় বেসরকারি মহিলা হোস্টেলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মাতৃস্নেহ, মাতৃনীড়, মাতৃছায়া, আইডিয়াল, পরশমণি, মাতৃনিলয়, প্রশান্তি, প্যারেন্ট কেয়ার ও মহানগর মহিলা হোস্টেল। এ ছাড়া আরো কয়েকটি ছাত্রী নিবাস রয়েছে।
চট্টগ্রাম কলেজ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কলেজের দুটি ছাত্রী হোস্টেলের আসন সংখ্যা ৪শ’২০। মহসিন কলেজের ১টি ছাত্রী হোস্টেলের আসন সংখ্যা ১শ’৬০। চট্টগ্রাম কলেজের প্রধান অফিস সহকারী মোহাম্মদ কিবরিয়া জানান, সরকারিভাবে এক সিটের মাসিক ভাড়া ১৮ টাকা। একজন ছাত্রীর খাবারের দায়িত্ব তার নিজের। ছাত্রীরা সবাই মিলে বাজার করে বাবুর্চি দিয়ে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করে থাকে। বাবুর্চির খরচ বহন করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সর্বমোট থাকা খাওয়াসহ একজন ছাত্রীর মাসিক খরচ অন্তত দুই হাজার টাকা। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ছাত্রশিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষের জের ধরে চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজের ছাত্র ও ছাত্রী হোস্টেল বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে বিপাকে পড়েন বিশেষ করে ছাত্রীরা। তাই নিরুপায় হয়ে ছাত্রীরা থাকছে বিভিন্ন বেসরকারি হোস্টেল, ম্যাচ ও সাবলেট বাসায়। এতে যেমন অধিক টাকা খরচ হচ্ছে তেমনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ছাত্রীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, কিছু ভবনের এক থেকে দোতলা, তিনতলা আবার কিছু ভবন পুরোটাই মহিলা হোস্টেল করা হয়েছে। চকবাজার রসিক হাজারি লেইনের পাশে বিন আলী টাওয়ারে পাঁচতলা ভবনের দোতলা পর্যন্ত করা হয়েছে মহিলা হোস্টেল ‘মাতৃনীড়’। আর এ দোতলা বিশিষ্ট মাতৃনীড় ছাত্রীনিবাসে বর্তমানে ছাত্রী সংখ্যা অন্তত ৫০ জন। একই গলিতে অবস্থিত মাতৃছায়া ছাত্রীনিবাস। এখানে আবার সম্পূর্ণ পাঁচতলা বিশিষ্ট ভবনেই তৈরি করা হয়েছে মহিলা হোস্টেল। এই হোস্টেলে ছাত্রী আছে প্রায় ১শ’৫০ জন। কেয়ারির পশ্চিম পাশে অবস্থিত আইডিয়ালের পাঁচতলা ভবনে ১শ’৫০ জন, পরশমনিতে ১শ’ থেকে ১শ’৫০ জন, মাতৃনিলয়ে প্রায় ১শ, চট্টগ্রাম কলেজের পশ্চিম পাশে প্রশান্তি হোস্টেলে প্রায় ১শ’৫০ থেকে ২শ’ জন, নবাব সিরাজুদ্দৌলা রোডে অবস্থিত প্যারেন্ট কেয়ারে ৬০ থেকে ৭০ জন ও মাতৃস্নেহে আছে প্রায় ৭০ জন ছাত্রী। সব মিলিয়ে এই মহিলা হোস্টেলগুলোতে বর্তমানে এক হাজারের বেশি ছাত্রী আছে। একটি ফ্লোরের এক রুমে চার জন করে চারটি রুমে ১৬ জন মেয়ে থাকে। হোস্টেলগুলোর ভিতরে দেখা যায় এক ফ্ল্যাটে একটি ড্রয়িং, ডাইনিং, দুই বা তিনটি বেডরুম। যে রুমে এটাস্ট বাথরুম সেই রুমের সিটগুলোর দাম তুলনামূলক বেশি। এমন একটি রুমে ছাত্রীদের তিন থেকে চারটি সিট আছে। তাদের থেকে বাড়তি ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা নেয়া হয়। আর অন্যান্য রুমের আয়তন অনুযায়ী সিট ব্যবহার করা হয়।
এদের সবার জন্য আবার একটি কমন বাথরুম থাকে। যার কারণে এই রুমগুলো এটাস্ট বাথরুমের চেয়ে একটু কম ভাড়া। দেখা যায়, একটি ফ্ল্যাটে গড়ে ১৬ জনের সিট থাকে। কিছু রুমে চারের বেশিও সিট আছে। সেগুলো ডাবল বেডের হয়ে থাকে। এভাবে একটি ফ্লোরে দুই ফ্ল্যাট করে পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি ভবনে দশটি ফ্ল্যাটে ১শ’৬০ জন মেয়ে থাকে। আর এসব রুমগুলোর মধ্যে একটি সিঙ্গেল সিট পাঁচ হাজার টাকা থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। আবার শেয়ার বেড বা ডাবল সিট সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে চার হাজার ৮শ’ টাকা। চকবাজারের বেসরকারি মহিলা হোস্টেল মাতৃনীড়, আইডিয়াল ও পরশমণি ছাত্রীনিবাসের কয়েকজন ছাত্রীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজে পড়াশোনা করেন। কলেজগুলোর আন্ডারে কোনো হোস্টেল না থাকায় এই বেসরকারি হোস্টেলগুলোতে থাকতে হয় ছাত্রীদের। আর অধিক টাকার বিনিময়ে এই হোস্টেলগুলো সার্ভিস দেয়। এসব হোস্টেলে খাবারের তুলনায় টাকা বরাবরেই বেশি। তাছাড়া হোস্টেলগুলোর সামনে বখাটেরা প্রায়ই আড্ডা দেয়। তাদেরকে হোস্টেল কর্র্তৃপক্ষ কিছু বলতেও চায়না। চকবাজারের পরশমণি, মাতৃছায়া ও আইডিয়াল হোস্টেল সুপাররা জানায়, বর্তমানে সবকিছুরই দাম বেশি। তাই যে পরিমাণ দাম নেয়া হচ্ছে তা মোটেও বেশি নয়। আর যেহেতু মেয়েদের জন্য কোনো সরকারি হোস্টেল নেই; তাই বেসরকারি হোস্টেলগুলো মেয়েদের জন্য উপকার হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে- কিছু কিছু ছাত্রী বাড়ী থেকে পড়ালেখার নাম দিয়ে টাকা এনে এসব হোস্টেলে বসবাস করছেন। মাঝে মাঝে বাড়তি টাকা আয়ের নেশায় তারা রাতে বাসা-বাড়ীতে ব্যবসায়ীদের মনোরঞ্জনের জন্য ছুটে যাচ্ছেন। হোস্টেলে ফিরে আসেন ভোরে। হোস্টেল কর্তৃপক্ষ এসব জেনেও টাকার লোভে এসব ছাত্রীদের হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা রেখেছেন। ওই সুযোগে এসব হোস্টেলের গার্ডরা মেয়েদের থেকে বখশিসও আদায় করছেন। এ যেন ছাত্রী হোস্টেল ঘিরে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে।