মা, তুই আমাকে একটি স্বপ্ন দিয়েছিলি। মাধুলির মতো
গলায় আমৃত্যু বাঁধা সেই স্বপ্ন এত ঝড়ঝঞ্ঝা ঠেলে
এত উত্থানে-পতনে বড় যতেœ খুব ঝুঁকি নিয়ে এত দূর
তবে তার বেশ বড় হয়ে গেছে, ধরতে পারে যে কোন আকাশ।
যদি মা বলিস তুই সেই স্বপ্নের নাম স্বাধীনতা, তবে তা
ভরা ফুলের উদ্যান কেন তার চেয়ে বড়ো...
কবি নাসির আহমেদের এই কবিতাটি অনেক প্রিয় তার। আর তাই অবসরে বিড়বিড় করে আবৃত্তি করে। আজও করছিল। এমন
সময় চাঁদ আসে। চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিল আর আবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছিল নিজের মত করে।
সকাল সাতটা বাজে। এখনও ওঠার নাম গন্ধ নেই । শুনি এভাবে আর কত সময় চলবে? ওঠ ওঠ...
চাঁদের স্বভাব হচ্ছে শামির ঘুম, গান আর কবিতা আবৃত্তিতে ছেদ ঘটানো। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই জ্বালাতন।
ঘুমচোখে চাদরের তলা থেকে মুখ বের করে চাঁদকে দেখে নেয়। তারপর পাঁচ-সাত মিনিট শুয়ে থেকে ঘুমভাব কাটিয়ে বলে আজ বছরের একটা দিন, আজকেও তুই জ্বালাবি?
এছাড়া আর আমার কোন কাজইতো নেই, তাই চলে এলাম... কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একজোড়া ঠোঁট এসে ঝাঁপিয়ে পরে চাঁদের উপর। চাঁদ আর কথা বলতে পারে না। কোন কথা ছাড়াই চলে দীর্ঘ সময়।
২.
বিছানা থেকে নেমে সোজা কিচেনে এলো হাসি। চুলা জ্বেলে চায়ের পানি বসালো। একটা চায়ের মগ ধুয়ে রেডি করল। কেবিনেটে রাখা একটা প্লাস্টিকের বয়ামে টোস্ট বিস্কুট আছে। দুটো টোস্ট বিস্কুট বের করে একটা কোয়ার্টার প্লেটে রাখলো। এই করতে করতে চোখের ঘুম হাওয়া। শীতল অভিব্যক্তি নিয়ে চাঁদ তাকায় শামির চোখে। আবার তাকায় নাফনদীর স্রোতের দিকে। স্রোতের দিকে তাকিয়ে একবার বলতে যাচ্ছিল নিজ জীবনের পোড় খাওয়া অধ্যায়ের কথা। ইচ্ছা হচ্ছিল বলতে, পুরুষ মানুষ ঘেন্না করে সে। ইচ্ছা হচ্ছিল বলতে, মাহমুদের গোপন লালসার কথা। থেমে যায় ইচ্ছা। মনে হচ্ছে, মনঃস্রোতের সঙ্গে কানেক্ট হয়ে গেছে নদীর স্রোত। মনে হচ্ছে, নদীর স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে মনের ঘরে জেগে ওঠা ময়লা-আবর্জনা। মনে হচ্ছে, ধুয়ে যাচ্ছে সে। স্রোতধারায় ভেতর থেকে পরিপূর্ণ শুদ্ধ হয়ে জেগে উঠছে ঘোমটা দেওয়া একটি বউ। বউটি হাসছে।
ঘোমটা দেওয়া বউটি যেন অবিকল তারই মুখ। বর সেজে পাশে আছে শামি। স্বপ্নের বীজ বুনে নেয় সে বুকের মাটিতে। ওই বীজ থেকে সংসার হবে তার। উঠোনো খেলবে দুই শিশু। স্বপ্নের ঘরে হামাগুড়ি দেয় চাঁদ। চাঁদের আলোয় আদরের রেনু খোঁজে জোস্নাবিলাসী শামি। চাঁদ মিষ্টি করে হাসে। মিটিমিটি হাসি দেখে পুলকিত হয় মনের প্রতিটি ইচ্ছে।
আঠারো বছরের মেয়েটি চঞ্চল ভঙ্গিতে গড়িয়ে পড়ে শামির শরীরে। এখানেই আদরের ঠিকানা খোঁজে সে। তার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শামি।
না আজ আর আরাম করতে দিবি না, তোর আদরের আরামটা আর বুঝি নেয়া হলো না...
কেন নেয়া হবে না কেন? এই নাও...বলেই আবার সামিয়ানা টানায় আদরের। এই সামিয়ানার নিচে থাকার জন্যেই শামি তার স্বপ্নটা আধ শোয়া করে দেখে। বিদায় জানিয়েছে বিমাতা আর বাবার সংসারকে।
তার খুব টিভি দেখার শখ। ছয় ইঞ্চি সস্তা টাইপের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট একটা টিভি আছে। একেবারেই ঝক্কা হয়ে গেছে। ছবি পরিষ্কার আসে না। ঝির ঝির করে। তাও ডিসের কানেকশন নেই, শুধু বিটিভি। মনোযোগ দিয়ে ওই বিটিভিই অনেকক্ষণ ধরে দেখে। মনে পড়ে এই টিভিটা তার কাছে আসার ইতিহাস।
কবিতার সাথে গভীর সম্পর্কওয়ালা একজন নারী তাদেরকে একসাথে থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, শামি আর চাঁদকি একসাথে থাকো?
শামি অনেক কৌশলী বরাবরই। সে খুব সুন্দর করে উত্তর দেয় না, আমাদেরকেতো এখনও কোন পক্ষই মেনে নেয়নি। কথাটা এক সময় অন্যদিকে বাঁক নেয়। তারপর কথায় কথায় মহিলা তার পুরোন এই টিভিটা শামিকে দেয়, বিনোদনের বিনিদ্র সময় কাটানোর জন্য। সেই থেকে টিভিটা প্রায়ই চলে বিনোদনের বাক্স হিসেবে। মাঝে মাঝে শামির গানের অনুষ্ঠান, চাঁদের কবিতার অনুষ্ঠান এই টিভিতেই দেখতে হয়। আজও দেখতে হবে। ঈদ উপলক্ষ্যে বিটিভির বিশেষ ম্যাগাজিনে তাদের দুজনেরই কবিতা ও গান রয়েছে...
৩.
ঈদেরদিন বিকেল বেলা মাহমুদ আসে শামিদের বাসায়। চাঁদ আগে থেকেই এড়িয়ে যেতে থাকে। আজও এড়িয়ে যাচ্ছিল। শামি বিষয়টি খেয়াল করলেও তখন কিছু বলে না। মাহমুদ চলে গেলে শামি জানতে চায় বিষয়টি। চাঁদ যা বলে তাতেতো শামির মেজাজ জ্বলতে থাকে কয়লার আগুনের মতো। মাহমুদের চোখ, চাওয়া আর চলনবলনে একটা উগ্রতা শামি আগে থেকে খেয়াল করলেও চাঁদের দিকে এভাবে কুদৃষ্টি দিবে ভাবতে পারেনি কখনো। হয়তো একারনেই মাহমুদ আজ বলছিল, কাঠের নড়বড়ে টেবিল। চেয়ার চারটাও নড়বড়ে। বার্নিশ মুছে গিয়ে কালচে হয়ে গেছে। কবে কার কাছ থেকে এই ডাইনিং টেবিল আর ওই যে ডাইনিংস্পেসের সঙ্গের জায়গাটায় রাখা বিশ্রী সোফাসেট, নামমাত্র দামে,কেনা। আমি নতুন কিনে দেই চাঁদ? প্রশ্নটার মধ্যে কেমন যেন একটা গন্ধ ছিল তা টের পেয়েছিল শামি। তাই বলে এতদূর...আর ভাবতে পারে না সে।
চটপটে হাতে চায়ের পানিতে চিনি দিয়ে নিয়ে আসে চাঁদ। একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, এত ভাবার কিছু নেই। আমি তোমার ছিলাম, তোমারই আছি। আজ চাঁদের পরনে বেগুনী রংয়ের সুতি শাড়ি। তেমন লম্বা না মেয়েটি,স্বাস্থবতী। চোখ দুটো ডাগর, সুন্দর। মুখটা খুব মিষ্টি, খুব মায়াবী। ঘন সুন্দর চুল পিছন দিকে ঝুঁটি করে বাঁধা। নাকের তলায়, গলায় চিনির রোয়ার মতো ঘাম। মুখ দেখেই বোঝা যায় অনেকটা সুখ তার মনের গভীরে। অপলক চোখে তাকিয়ে আছে শামির দিকে। চোখে পলকই পড়ছে না। শামিও খানিক তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল, মনে থাকবেতো?
এবার চোখে পলক পড়ল সেই চাঁদের। একটু যেন চঞ্চল হলো। বলল, খুব থাকবে।
আবার আগের মতো অপলক চোখে তাকাল। মুখটা স্নিগ্ধ হাসিতে উজ্জ্বল হলো।
৪.
শামির চোখের পাতায় ভাসছে চাঁদের পরনে বেগুনী রংয়ের সুতি শাড়ি।
স্বাস্থবতী শরীর। দুটো ডাগর, সুন্দর চোখ । খুব মিষ্টি, খুব মায়াবী মুখ। ঘন সুন্দর চুল। পিছন দিকে ঝুঁটি করে বাঁধা অনন্য সুন্দর দোলনা। নাকের তলায়, গলায় চিনির রোয়ার মতো ঘাম।
মনের নদীতে পাল তুলে দেয় অপলক চোখে তাকিয়ে থাকা চাঁদ। এখনও মনে হচ্ছে চোখে পলক পড়ছে না চাঁদের। শামিও তাকিয়ে আছে।
কানে ভাসছে , চঞ্চল শব্দ , মনে থাকবে, খুব থাকবে।
কিন্তু মনে থাকেনি। ভুলে গেছে ভায়োলিন বাজানো ভোরের কথা। ভুলে গেছে স্বপ্নজ সময়ের কথা।
গতকাল মাহমুদ আর চাঁদকে দেখেছে দামি গাড়ির দেহে চড়ে চলে যাচ্ছে বনানীর আবাসিক এলাকার দিকে...