বিজ্ঞানের মূল কাজ হচ্ছে প্রকৃতিকে অনুধাবন করা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং গাণিতিক যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রকৃতির রহস্যকে বিজ্ঞান উন্মোচন করে, সৃস্টি করে নতুন জ্ঞান। বিজ্ঞানের এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির নানাবিধ ব্যবহারের ফলে মানুষ একদিকে তার দৈনন্দিন জীবনকে করছে আরামদায়ক; মানব সভ্যতাকে সচল রাখছে প্রগতির পথে। জাতীয় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্য সেবা কিংবা শিক্ষার উন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কার্যকরী ব্যবহার এখন তাই সময়ের দাবী। বিভিন্ন বেসকারী শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগ উপযোগী করার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ক্লাস রুমে পাঠ দান করার জন্য মডেম, ল্যাপটপ, প্রজেক্টার শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে প্রশংসা কুড়ালেও শুধু মাত্র দেখভাল করার অভাবে, শিক্ষকদের রহস্যজনক দায়িত্বে কর্তব্যে অবহেলা করার জন্য এসব আধুনিক উপকরণের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে এগুলি প্যাকেটজাত, খেলনার উপকরণে পরিণত হয়েছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার শিক্ষক, অন্যান্য শিক্ষকগন অনলাইল সম্পর্কে ধারনা না থাকায় রেজিষ্ট্রেশন, ফরম ফিলআপ এর কাজগুলি কম্পিউটার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞনাগার নেই, গ্রন্থাগার না থাকায় পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের ভিশন ২০২১- এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্কুল পর্যায় থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত কম্পিউটার ও কারিগরি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১৩ সাল হতে প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০১৬ সালেই ৬ষ্ঠ শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থী বছরের শুরুতে পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি ডিজিটাল কন্টেন্টসহ একটি করে ট্যাব দেয়ার কথা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়নি । ২০২১ সালের মধ্যে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে শিক্ষার সকল স্তরে কম্পিউটার ব্যবহার নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হবে। আর যারা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ব্যপারে বিরুপ মন্তব্য করছিলেন তারাও এর সুফল ভোট করছেন।সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রমের বর্তমান ফাইলভিত্তিক ব্যবস্থাকে ই-গভর্নমেন্ট বা ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থায় রূপান্তর করা হচ্ছে, ই-লার্নিং এবং জনগণকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবাদান নিশ্চিত করে সেবার মান ও ক্ষেত্র বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কম্পিউটার, সফটওয়্যার ও সেবা খাতের রপ্তানীসহ কম্পিউটার প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ পুরো দেশে ইন্টারনেটের প্রসার ঘটানো ও ইন্টারনেট সেবার মূল্য জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আবার, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপকতর প্রসারের ফলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে যারা অক্ষম হবেন তাদের জন্য জীবনযাপন আরও কঠিন হয়ে যাবে। তাদের অবস্থা হবে ড্যাসবিনের টিসু পেপারের মত। বিদ্যমান অবস্থায় গ্রামের দরিদ্র্য মানুষ যারা কোনমতে তাদের জীবনযাপন করতে পারেন ডিজিটাল প্রযুক্তি তার সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ডিজিটাল বৈষম্যের কথা উল্লেখ করতে হয়। ডিজিটাল বৈষম্য হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাধারণ ব্যবহার এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সেবা পাবার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসমতা। এটি উন্নত বিশ্বের সাথে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে যেমন হতে পারে, তেমনি একটি জাতির নিজস্ব জনগোষ্ঠির মধ্যেও হতে পারে। বর্তমানে উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে এটি মূখ্য উপাত্ত । অপেক্ষাকৃত দরিদ্র্য মানুষ আইসিটির সুফল উপভোগ করতে না পারলে দেশ এগোবে না। প্রতি বছরই আইসিটি এবং ইন্টারনেট এ দুটি শক্তিশালী টুলস ব্যবহার করে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন মানোন্নয়নে কোন কোন দেশ এগিয়েছে এ তালিকা প্রকাশ করে “ইন্টারন্যাশনা টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন”। তাদের প্রকাশিত ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে ১৬৬ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১৪৫ তম । বাংলাদেশের এই দুঃখজনক অবস্থানের পেছনে বিদ্যুৎ সেক্টরসহ আরো কিছু অবকাঠামোগত দুর্বলতার পাশাপাশি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে দক্ষ জনশক্তির অভাবকে। তাই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার সার্বজনীন সুযোগ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্নের সুফল কেবলমাত্র সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর মানুষই ভোগ করতে পারবে। সরকারী এসব উদ্যোগের সাথে সাথে জনগণকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করতে প্রয়োজন যথাযথ ও কার্যকরী বিজ্ঞান ও কারিগরী শিক্ষা। এক্ষেত্রে, বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে প্রযুক্তি শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা ও মানবিক শিক্ষার যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে সেটিকে অনুধাবন করে একটি সমন্বিত শিক্ষার অংশ হিসেবে বিজ্ঞান শিক্ষাকে শিক্ষার্থীদের কাছে নেয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান মনষ্ক করে অর্থাৎ স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ও প্রশ্ন করার মানসিকতা তৈরী করে তাকে তার পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সচেতন করে তার ভেতরের সৃজনশীলতাকে বিকশিত করার সুযোগ দিতে হবে। অন্যথায় এ ডিজিটাল বৈষম্য বাড়তে থাকবে।
বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার সার্বিক অবস্থা সন্তোষজনক নয়। গত দুই দশকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্য়ায়ের শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশে মোটের ওপর শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে গমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান, বিশেষ করে বিশ্বের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান সমৃদ্ধ শিক্ষার মান এবং বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে। ফলে আশংকা হচ্ছে, শ্রীঘ্রই আমরা হয়তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জাতির বদলে প্রযুক্তি ব্যবহারকারী জাতিতে পরিণত হবো।
ইধহমষধফবংয ইঁৎবধঁ ড়ভ ঊফঁপধঃরড়হধষ ওহভড়ৎসধঃরড়হ ্ ঝঃধঃরংঃরপং (ইঅঘইঊওঝ) এর তথ্য মতে, ২০০১ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ১০০ জন। আর ২০০৮ সালে একই বিভাগে পরীক্ষার্থী কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮০ জন। অর্থাৎ কমেছে প্রায় ৮৭ হাজার। অথচ একই সময়ে ২০০১ সালে বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৮২১ জন এবং ২০০৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪৪১ জন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বৃদ্ধি প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার। এইচএসসিতেও এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোর চিত্র সবচেয়ে বেশী উদ্বেগজনক।
বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়া করার প্রতিবন্ধকতা নানামূখী। বিজ্ঞানাগার সুবিধার অভাব, বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব, বিজ্ঞান সিলেবাস, পারিবারিক অসচ্ছলতা, সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা ও আগ্রহের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, গ্রাম অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর দুই-তৃতীয়াংশ বিদ্যালয়ে কোন বিজ্ঞানাগার নেই। এসব স্কুলের অনেকগুলোতে সাম্প্রতিক বছরে সরকার থেকে কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়া দিলেও শিক্ষার কাজে তা খুব কমই ব্যবহৃত হয়। সেগুলো অনেক স্কুলেই ‘শোপিস’ হিসেবেই ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। স্কুলে নিয়মিত ব্যবহারিক ক্লাস হয়না, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে অনেক স্কুলে নির্বাচনী পরীক্ষার পরে তা করানো হয়। রাজশাহী জেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাগুলোর বিজ্ঞান শিক্ষার সার্বিক অবস্থা দেশের সামগ্রিক অবস্থারই প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশ (বিএফএফ)’র সহযোগিতায় সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ফর ভলান্টারী অর্গানাইজেশন (সিসিবিভিও) ২০১২ হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার ৪০ টি স্কুল ও মাদ্রাসায় ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়ন’ শীর্ষক এ্কটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। পরবর্তীতে এ প্রকল্পটি ২০১৭ সাল হতে আরো ৫ুুু০ টি প্রতিষ্ঠানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সিসিবিভিওসহ বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও সচেতন রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী, মোহনপুর, পবা এবং চারঘাট উপজেলায় বর্তমানে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিজ্ঞান শিক্ষাকে আনন্দদায়ক ও জনপ্রিয় করা; সর্বোপরি স্কুলগুলোর বিজ্ঞান শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ প্রকল্পের মাধ্যমে স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান ক্লাব গঠন করে শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞান শিক্ষকগণের সহায়তায় বিজ্ঞান মেলা, বিজ্ঞান বিষয়ক কুইজের আয়োজন, দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, বিজ্ঞান বিতর্ক আয়োজন, বৃক্ষরোপন ইত্যাদি নানা সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। একসময় দেশে হাতেগোনা কিছু মানুষের কাছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি জ্ঞান ছিলো, অল্প কিছু মানুষের হাতে কম্পিউটার ছিলো, তখন এই থাকা-না-থাকার বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবিনি, কিন্তু এখন যখন সরকার একটি বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞান নির্ভর একটি সমাজ ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তখন এই থাকা না থাকার বিষয়টি সামনে চলে আসে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা পাওয়া-না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হয়। বর্তমান সরকার শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তথ্য ও যোগাযোগা প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে বদ্ধ পরিকর। যার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশের সিংহভাগ মানুষ যারা গ্রামে বাস করে তাদেরকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করার দাবী তাই খুবই সময়োপযুগী। সমতা ও সমান সুযোগ লাভের সাংবিধানিক অধিকারও এর মধ্যে দিয়ে নিশ্চিত হবে। মো: হায়দার আলী,
প্রধান শিক্ষক,
মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়,