বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক সভ্যতার কথা চিন্তাই করা যায় না। বর্তমান সরকার যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে তার জন্যও বিদ্যুতের ভূমিকাই মুখ্য। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হবে। এদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় জনসংখ্যার বৃহৎ একটি অংশের বিদ্যুৎ কেনার সামর্থ্য নেই। এখনও দেশের নি¤œ আয়ের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিইআরসি’র এক গণশুনানিতে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পাইকারিতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। তবে প্রস্তাব পর্যালোচনা করে বিইআরসি বলছে, সরবরাহ ব্যয় সমন্বয় করতে ইউনিট প্রতি ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানো যেতে পারে। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে বিতরণ সংস্থাগুলোর ব্যয় বেড়ে যায়। এই ব্যয় সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। যখন নিত্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী তখন এর সাথে বিদ্যুতের বাড়তি দামের বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে শুনানিতে পিডিবি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাইকারিতে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় ছিল ৫ টাকা ৮৩ পয়সা। এখন বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ৪ টাকা ৭৭ পয়সা। এর ফলে গত অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৬২৩ মিলিয়ন টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। ২০২০ পঞ্জিকা বছরে গড় সরবরাহ ব্যয় হবে ৫ টাকা ৮৮ পয়সা হবে। কিন্তু বর্তমান মূল্য বজায় থাকলে এবছর ঘাটতি হবে ৮৫ হাজার ৬০৬ মিলিয়ন টাকা। এ ঘাটতি পোষাতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য এক টাকা ১১ পয়সা বাড়ানো প্রয়োজন। দাম বাড়ানোর কারণ হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, গ্যাসের মূল্য ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি, কয়লার ওপর নতুন করে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি ও কোনো কোনো বিতরণ সংস্থা কর্তৃক সময় মতো টাকা পরিশোধ না করাকে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির পক্ষে জানানো হয়েছে, তাদের পর্যালোচনায় পাইকারি মূল্য ৯৩ পয়সা বা ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানো যেতে পারে। আগামী বছর প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসানের পূর্বাভাস দিয়ে বিইআরসির দ্বারস্থ হয়েছে পিডিবি। পিজিসিবি চায়, চার বছর আগে নির্ধারণ করা তাদের সঞ্চালন চার্জ তিন ধাপেই বাড়ানো হোক। প্রথম দিনের শুনানিতে পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার পরিবর্তন ও সঞ্চালন মূল্যহার পরিবর্তনের প্রস্তাবের ওপর শুনানি চলে। আমরা আশা করি শুনানি শেষে একটি সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবহৃত গ্যাস ও কয়লায় ওপর ভ্যাট কমিয়ে বা নবায়নযোগ্য জ¦ালানির বিকল্প ব্যবস্থা করে এক একটি সুরাহা করা প্রয়োজন।
সরকার নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। রূপপুর পারিমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আরও কতগুলো বড়বড় প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। একথা সত্যি যে, আগের চেয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি আনেকটা কমেছে। তবে এখনও লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ রেশনিং করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুরি একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার। এর সঙ্গে বিদ্যুৎবিতরণকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে। এছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালণ লাইনের ত্রুটি ও অব্যাবস্থাপনায় সিস্টেম লসের কারণেও বিদ্যুতের অপব্যয় ও ঘাটতি দেখা যেতে পারে। এসব সমস্যার সমাধান না করে করে বিদ্যুতের জন্য বাড়তি ব্যয় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। এতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে যেমন একটি বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে তেমনি সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি হবে।