 |
দিল্লিতে একই পরিবারের ১১ সদস্যের মৃত্যু নিয়ে পুলিশ যতই তদন্ত করছে, ততই অবিশ্বাস্য সব তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে আসছে। পরিবারটি এমন এক প্রথায় বিশ্বাস করত, যেটি এ যুগে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না।
পুলিশ নিহতদের বেশ কিছু হাতে লেখা ডায়েরি ও চিরকুট উদ্ধার করেছে। হাতের লেখা মিলিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, এগুলো নিহত সদস্যদেরই। এসব চিরকুট থেকে এ ‘গণ-অাত্মহত্যার’ পরিকল্পনার কারণ জানতে পেরেছে পুলিশ। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, ওই রাতে বাইরের কেউ ওই বাড়িতে প্রবেশ করেনি।
১ জুলাই, রবিবার রাতে দিল্লির বুরারি এলাকায় নিজেদের বাড়ি থেকে ভাটিয়া পরিবারের ১১ সদস্যের হাত-পা বাঁধা ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দিল্লি পুলিশ বলছে, পরিবারটি সাত দিনব্যাপী এক ‘প্রথা’ পালন করতে গিয়ে এভাবে মারা গেছে। কিন্তু এভাবে ‘আত্মহত্যা’ করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তাদের।
উদ্ধার হওয়া চিরকুটের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, ভাটিয়া পরিবার যে প্রথায় বিশ্বাস করত, সে প্রথা অনুসারে পরিবারের মঙ্গলের জন্য গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার একটি নিয়ম ছিল। পরিবারটি এ নিয়মটিই পালন করতে গিয়েছিল। এমনকি তাদের পরিবারের সমস্যাগ্রস্ত এক সদস্যকে নিয়ে একই কাজ আবার করার পরিকল্পনাও ছিল তাদের।
আলোচিত এ ঘটনায় পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি নারায়ণ দেবী (৭৭), তার দুই ছেলে ভবনেষ (৫০) ও ললিত (৪৫), তাদের স্ত্রী সাবিতা (৪৮) ও টিনা (৪২), নারায়ণ দেবীর মেয়ে প্রতিভা (৫৭) ও নারায়ণ দেবীর পাঁচ নাতি-নাতনি প্রিয়াঙ্কা (৩৩), নিতু (২৫), মনু (২৩), ধ্রুব ও শিবাম মারা গেছেন।
নারায়ণ, ভুবনেষ ও শিবামের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গলায় দড়ি দেওয়ার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
ঘটনার এক দিন পর সোমবার পুলিশ দুটি ডায়েরি উদ্ধার করে। ওই ডায়েরিতে পরিবারটি যে প্রথা পালন করত, সে বিষয়ে উল্লেখ ছিল। মঙ্গলবার পুলিশ আরও ৯টি ডায়েরি এবং শত শত চিরকুট উদ্ধার করে। মোট ১১টি ডায়েরি ১১ বছর ধরে লেখা হয়েছিল। (১১ খুন, ১১ ডায়েরি, ১১ বছর—এখানেও রহস্য!) এসব ডায়েরি ও চিরকুটগুলোতে এ প্রথার বিস্তারিত উল্লেখ ছিল। ডায়েরি ও চিরকুটের লেখাগুলো ললিত, প্রিয়াঙ্কা ও পরিবারেরই আরেকজন সদস্যের বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
ঘটনাটি তদন্তে নিয়োজিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘চিরকুট থেকে জানা গেছে, টিনার বোন মমতাকে নিয়ে আবারও এভাবে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার প্রথা পালনের পরিকল্পনা ছিল তাদের।’ কিন্তু মমতা দাবি করছে, তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
ভাটিয়া পরিবারের এক প্রতিবেশীর বাসার সিসিটিভিতে ওই রাতের ফুটেজে সাবিতা ও তার মেয়ে নিতুকে দেখা গেছে। রাত ১০টার ওই ফুটেজে এ দুজনকে টুল জড়ো করতে দেখা যায়। ১৫ মিনিট পরে ধ্রুব ও শিবামকে দোকান থেকে দড়ি কিনে আনতে দেখা যায়। পুলিশ বলছে, ওই টুল ও দড়ি ‘অাত্মহত্যার’ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
চিরকুটের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ২০০৭ সালে এ পরিবারটির প্রধান ব্যক্তি ভূপাল সিং মারা যান। এর কয়েক মাস পর থেকেই পরিবারটি একটি অদ্ভুত প্রথা পালন শুরু করে। ভূপাল সিংয়ের মৃত্যু সাজানো-গোছানো পরিবারটিকে তছনছ করে দেয়।
ভূপালের তৃতীয় সন্তান ললিতই বাবার মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল। ললিত তার পরিবারকে বলে যে, বাবার আত্মা তার মধ্যে ভর করেছে। এরপর ললিতের মা ছাড়া পরিবারের বাকি সবাই তাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতেন।
ললিতকে ‘বাবা’ ডাকা শুরু করার পর থেকে পরিবারটি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া শুরু করে। ললিত ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন এবং সেখান থেকে বেশ লাভ করেন। এতে করে বাবার আত্মা নিজের মধ্যে ভর করার যে দাবি ললিত করেছেন, তা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
এ বছরের শুরুতে পরিবারটির একজন সদস্য প্রিয়াঙ্কা যখন একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে বাছাই করেন, তখন পরিবারের সব সদস্যই খুব খুশি হয়েছিল। গত ১৭ জুন তাদের বাগদানও হয়ে যায়। বাগদানের পরই ললিত পরিবারের সদস্যদেরকে ‘থ্যাংকসগিভিং সিরিমনি’র মতো একটি উৎসব পালনের নির্দেশ দেন। কিন্তু তখন বাড়িভর্তি মেহমান থাকায় তারা অপেক্ষা করেন। জুনের ২৩ তারিখ মেহমানরা সবাই একে একে বিদায় নেন। এরপরই সাত দিনব্যাপী ওই ধন্যবাদ উৎসব পালন শুরু করে পরিবারটি। এ উৎসবের কথা গোপন রাখাও আরেকটি প্রথা।
চিরকুট অনুসারে, প্রথম ছয় দিন তারা চোখ, হাত-পা বাঁধার প্রশিক্ষণ নেন। শেষদিনের পরিকল্পনা ছিল ছাদের সিলিং থেকে গলায় দড়ি দিয়ে সবাই ঝুলে পড়া।
সিসিটিভির ফুটেজ দেখে পুলিশ বলছে, টুল ও দড়ি সপ্তম দিনেই সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এসবের সাহায্যে চিরকুটের লেখার মতোই সবাই ছাদের সিলিং থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে।
চিরকুট থেকে জানা গেছে, পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাস করতেন এভাবে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়লেও তারা মারা যাবেন না, বরং তারা ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী হবেন। কিন্তু তাদেরকে মৃত্যুই বরণ করতে হলো।
এদিকে একই পরিবারের ১১ সদস্যের ‘মৃত্যু’র সঙ্গে ‘১১’ সংখ্যাটি রহস্যজনকভাবে জড়িয়ে গেছে। দিল্লির যে বাড়ি থেকে ভাটিয়া পরিবারের ওই সদস্যদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সে বাড়িটির পেছনের দেয়ালে মোট ১১টি পাইপ আছে। বাড়ির সদর দরজাটি ১১টি রড দিয়ে তৈরি। ওই বাড়ির জানালা সংখ্যাও ১১টি।
বাড়ির পেছনে যে ১১টি পাইপ আছে, তার মধ্যে চারটি সোজা ও সাতটি বাঁকানো। এখানেও ‘মৃতের’ সংখ্যার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে চার পুরুষ ও সাত নারী ছিলেন।
এ ঘটনাটি ভারতে স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ও রহস্যের জন্ম দিয়েছে।