বিকাল তিনটার দিকে ফোনটা ধরেই প্রায় চিৎকার করে সঞ্জয় বলল, ‘মেয়ে হইছে মানে কী?’ তারপর দশ সেকেন্ডের একটা পজ দিয়ে শব্দ করে হেসে উঠে বলল, ‘পাগলি!’ মেয়ে হয়েছে শুনেই আশপাশের ডেস্ক থেকে তার কলিগরা যার যার জায়গায় বসে কানটা লম্বা করে সঞ্জয়ের কান আর ফোনের স্পিকারের মাঝে ফিট করে দিল। কিন্তু পাগলি বলার পরেই সঞ্জয়ের কথা শেষ হয়ে গেল, হাসতে হাসতে ‘বাই’ বলে ফোন রেখে দিল। যদিও তার কলিগরা জানে সঞ্জয়ের বউ প্রেগন্যান্ট নয়। বছর পাঁচেক হয়েছে তাদের বিয়ের, এখন একটা মেয়ে তাদের হতেই পারে। কিন্তু মেয়ে তো আর ধুম করে আকাশ থেকে পড়ে না। কলিগদের বা বন্ধুদের মেয়ে বা ছেলে হলে সেটা কয়েকমাস আগে থেকে জানা যায়। তাহলে কার মেয়ে হলো? কিন্তু মেয়ে যারই হোক, সঞ্জয় সেটা উচ্চারণ করেছে, কাজেই মিষ্টি খাওয়ার টাকা তাকেই দিতে হবে।
সঞ্জয়দের অফিসটা ঢাকার তেজগাঁওয়ে একটা পরকীয়া পত্রিকা অফিস। ভাড়া করা অফিস বলে পরকীয়া ধরনের অফিস, তা নয় কিন্তু। অফিসের ভেতরটা বারোয়ারি সে কারণেও নয়। আজকাল পরকীয়া শব্দটা এত শোনা যাচ্ছে যে, মনে হয় এটা একালের শব্দ। শব্দটা মনে হয় তৈরি হয়েছে এরকম খোপ খোপ পত্রিকা অফিসের কোনো একটা খোপে। আসলে এসব অফিসে ফোনে কথা বলা আর গোপন কথা ঢোল পিটিয়ে বলা একই। এরা দেশের দশের গোপন খবর চাউড় করতে করতে নিজেদের গোপন কথা গোপন করতে ভুলে গেছে। তাহলে এটাকে বা এ ধরনের অফিসকে পরকীয়া অফিস বলা কি ঠিক হচ্ছে? পরকীয়া খুব গোপন ব্যাপার না? না মনে হয়, গোপন হলে এত লোকে জানে কিভাবে?
সবাই তুমি না আসাদ! তোমার মতো মেয়ে অন্তপ্রাণ বেশি নাই!
কিন্তু সঞ্জয়ের ফোনটা বউ করেছিল কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া যায় নাই। সঞ্জয়ের কোনো পরকীয়া আছে নাকি, যার একটা মেয়ে হয়েছে, এবং অবৈধ কন্যার আগমনে একটুও বিচলিত না হয়ে সে দিব্যি অফিস করছে। নাকি তার পরকীয়া প্রেমিকা থাকে দূর দেশে? দূর দেশে থাকলে মেয়ে হলো কিভাবে? তখন সবার একযোগে মনে পড়ল বছরখানেক আগে তিনমাসের জন্য জার্মানি গিয়েছিল সঞ্জয়! সাংবাদিকদের এই জার্মান স্কলারশিপ নিয়ে বাজারে নানা রকমের চুটকি চালু আছে। তবে চুটকি যা-ই চালু থাক, এইবার কিন্তু হিশেব মিলেছে। জার্মানি গিয়ে প্রেম করে এলে, এখন একটা মেয়ে হতে পারে। মাসের হিশাব মেলামাত্র পাশের ডেস্কের আসাদ বলল, দাদা টাকা দেন, মিষ্টি খাব। সঞ্জয় তখন খুব মন দিয়ে একটা অনুবাদ করছিল, কিসের মিষ্টি জিজ্ঞাসা না করেই পাঁচশ টাকার একটা নোট দিল। টাকা নিয়ে হইহই করতে করতে বেরিয়ে গেল চারজন। নিচে নেমে চারজন চা খেতে খেতে মিতু বলল, ‘সঞ্জয় মনে হয় মেয়ে হওয়াতে খুশি হয় নাই! দেখিস না কেমন চুপ মেরে গেছে!’ আসাদ যথারীতি গলায় বাড়তি আশ্চর্য ঢেলে বলল, ‘খুশি হয় নাই! মেয়ে হওয়াতে! এটা কখনও হতে পারে, মেয়ের বাপ হওয়াই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় খুশি!’ এবার চারজনে একসাথে বলল, ‘সবাই তুমি না আসাদ! তোমার মতো মেয়ে অন্তপ্রাণ বেশি নাই!’ এবার আসাদ লজ্জা পেয়ে গেল। জিনাত হঠাৎ বলল, ‘পরের জন্মে আমি আসাদের মেয়ে হতে চাই!’ মিতু বলল, ‘এই জন্মেই হও, আজ থেকে আসাদকে বাবা ডাকো!’ এটা নিয়ে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করে বিজন বলল, ‘আহা রে সঞ্জয়ের বউটা কী সুইট!’ বিজনের গিবতে পানি ঢেলে জিনাত বলল, ‘যদি মেয়ে হওয়াতে খুশি না হয়, তাহলে মিষ্টি কেনা ঠিক হবে না। চল মোগলাই পরোটা কিনা নিয়া যাই। পাঁচশ টাকায় অনেকগুলা হবে, পুরা অফিস খায়া ফুটবল হয়া যাবে।’ আস্ত মানুষ ফুটবল হবে নাকি শুধু পেটটা টিল্লিস হয়ে, হাওয়া ভরা ফুটবল হবে সেটা নিয়েই ঘণ্টা খানেক আড্ডা দিতে পারত তারা। কিন্তু সাংবাদিকরা যতই দিনভর চা-সিগারেট খাক, কিছু কাজ তো তাদেরও করতে হয়। এখন টাকা যেহেতু আদায় হয়েছে, আর জনসংখ্যা একটা ব্যাপার, তিনজনে মোগলাইয়ে একমত হলো। কিন্তু মুশকিল হলো, দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে এতগুলা বানিয়ে নিয়ে অফিস ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। ঠিক হলো অর্ডার দিয়ে তারা অফিসে ফিরে যাবে। বানানো হয়ে গেলে মিসকল দেবে দোকানি। অফিসে ফিরে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তারা।
সঞ্জর আর জিনাতের মাঝখানে আসাদের ডেস্ক। হাসিখুশি ছেলে, খুব গল্প লেখার বাতিক আর বেজায় বউ-পাগলা। বউয়ের নাকের ডগায় ঘাম জমলে তার নাকি জগৎ-সংসার তুচ্ছ লাগে, খালি নাকি তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে! বছর দুয়েক আগে তাদের একটা মেয়ে হয়েছে, সেই মেয়ের জন্যেও সারাক্ষণ অস্থির সে। তার ডেস্কে ফ্রেমে বাঁধানো বউ আর মেয়ের ছবি। আসাদের বউ মিলির অফিস পান্থপথে, ব্যাংকার। সকালে মিলি বেরিয়ে গেলে সে মেয়েকে নিয়ে নাস্তা খায়। মেয়ের সঙ্গে রাজ্যের গল্প করে, সে গল্পে ট্রাম্প যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে খুব খারাপ হয়েছে, হিলারি হলে কত ভালো হতো থেকে জেরিটা বেশি দুষ্টু পর্যন্ত জগতের সকল বিষয় থাকে। তারপর মেয়েকে গোসল করিয়ে, রেডি করে ঝিকাতলা মেয়ের নানির বাড়ি যায়। নানির কাছে মেয়েকে রেখে অফিসে আসে।
দুপুরে আড্ডা আর গুলতানিতে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে বলে সবাই মন দিয়ে কাজ করছিল। খানিক আগে রিপোর্টার সুজন একটা নিউজ দিয়ে বলেছে, ‘আসাদ ভাই, এই নিউজটা ভালো করে দেইখেন।’ সেই নিউজটাই এডিট করছিল আসাদ। হঠাৎ সে ‘না’ বলে চিৎকার করে উঠল। সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। জিনাত জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হইছে রে?’ কয়েক পা এগিয়েই ধাম করে পড়ে গেল সে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে শুধু বলল, ‘মেয়ের কাছে যাব।’ পানির ছিটা খেয়ে টেয়ে সে যখন উঠে বসল, তখন সুজন জিজ্ঞাসা করল, ‘ওই নিউজটা, আসাদ ভাই?’ আসাদ আবারও বলল, ‘মেয়ের কাছে যাব, সঞ্জয়দা, আমাকে ছুটি দেন আজ।’
চলে গেল আসাদ। মোগলাই পরোটার দোকানে আসাদের ফোন নম্বর দেওয়া ছিল, সে-কথা কারো মনে পড়ল না। সুজন বলল, ‘জিনাত আপা, তাইলে আপনে নিউজটা দেইখা দেন।’ জিনাত নিউজ দেখতে শুরু করে বুঝল, কেন আসাদ ওরকম করল। দুই বছরের বাচ্চাকে রেপ করে ছাঁদ থেকে ছুড়ে ফেলে, মেরে ফেলা হয়েছে। জিনাত নিউজটা এডিট করে ছেড়ে দিল। তখন আসাদের ফোন এল, ‘মোগলাইওয়ালা ফোন দিছে, যান নিয়া আসেন।’ জিনাত চোখে মুখে পানি দিয়ে মোগলাই আনতে গেল। মোগলাই খেতে খেতে কেটে গেল অফিসের গুমোট আবহাওয়া। ফেসবুকে কেউ একজন দিয়েও দিল, ‘মেয়ে হইছে বইলা মোগলাই খাই, মেয়ে যেন নূরজাহানের মতো পাওয়ারফুল হয়।’ সঞ্জয়কে ট্যাগ করে সেই পোস্টে সঞ্জয়ের বউ শিফা লিখল, ‘কার মেয়ে হইছে?’ তার উত্তরে একজন লিখল, ‘আমরা জানি না, সঞ্জয়দা জানে। বিকাল তিনটায় একটা ফোন আইছিল!’ আধা ঘণ্টার মধ্যে শিফা চলে এল অফিসে। এসেই হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল।
শিফা চাকরি করত একটা এনজিওতে। তিন মাস হয় চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে সে। তার নাকি বাচ্চাদের স্কুলে পড়ানোর শখ হয়েছে। একটা স্কুলে হয়েও গেছে চাকরি, সামনের মাসে জয়েন। অবসর বলে সে প্রচুর সিনেমা দেখে। জানা গেল, আজ সে খুব মজার একটা সিনেমা দেখছিল, সাতাশ আর সতেরো বছরের দুই ছেলের প্রায় বৃদ্ধ বাবা-মা আবার প্রেগন্যান্ট হয়েছে। বড় ছেলে প্রেম করে, সামনে বিয়ে, এই সময় এই খবর কী ভীষণ কা- ঘটিয়েছে, সেই নিয়ে সিনেমা। দেখতে দেখতে সঞ্জয়কে সে ইনবক্সে বলেছে মজার সিনেমার কথা। সঞ্জয় অত মন দিয়ে মেসেজ দেখে নাই হয়তো। সিনেমা শেষে যখন ওই বৃদ্ধ দম্পতির মেয়ে হয়েছে, তখন সে ফোন করে বলেছে, ‘মেয়ে হইছে।’ সেই সিনেমার মেয়ে হওয়া উপলক্ষে মোগলাই খাওয়া তো হয়ে গেছে, এখন তো আর ফেরানো যাবে না। সবাই হইহই করে বলল, সঞ্জয় আর শিফার আসল মেয়ে হলে তারা অবশ্যই কাচ্চি বিরিয়ানি খাবে। যেহেতু মিষ্টি খাওয়া হলোই না, তাই তারা ঝালই খাবে বলে ঠিক করল।
পরের দিন অফিসে এসে আসাদ বলল, চাকরি ছেড়ে দেবে সে, দোকানদারি করবে, মেয়েকে সারাদিন কাছে রাখবে। ধানমন্ডি সাতাশের জেনেটিক প্লাজায় সে বই আর সিডির দোকান দেবে। অফিসের সবাই মিলে বোঝাল, ‘আরে সাংবাদিকের মন এত নরম হলে চলে?’ একজন বলল, ‘সিডির দিন কি আর আছে?’ বেশি কথাবলা জিনাত রীতিমতো লেকচার দিলÑ‘এমন করিস না আসাদ, বই কি কেউ পড়ে আজকাল? বউয়ের একলার বেতনে চলতে পারবি? মেয়ে বড় হচ্ছে না? স্কুলে যাবে না? খরচ বাড়বে না?’ কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। দুজনে চাকরি করে বলে তাদের ভালোই চলত। ঝিকাতলায় বড়সড় একটা বাসা ছিল তাদের। সে বাসা ছেড়ে দিয়ে মোহাম্মদপুরে ছোট দেখে একটা বাসা নিল। পরের মাসে চাকরি ছেড়ে দিল। অফিসে যা পাওনা ছিল, সব তুলে নিল। অফিসের সবাই দুইটা তিনটা করে নতুন বই কিনে তার দোকানের জন্য উপহার দিল।পত্রিকা অফিস থেকে একজন চলে গেলে আছর পড়ে না তেমন। কিন্তু আসাদ চলে যাওয়ার পর পুরা অফিসটা কেমন ঝিম মেরে গেল। সবাই অফিসে আসে, যার যার কাজ করে চলে যায়। আড্ডা হয় না, হাসাহাসি হয় না। দুয়েকদিন পরপর একটা করে এসি নষ্ট হয়ে যায়। এসি ঠিক হতে হতে কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যায়। কারো না অসুখ হয়, ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা নষ্ট হয়। নিরানন্দ একঘেয়ে অফিস করতে করতে ক্লান্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে অন্য অফিসে চলে গেল কেউ কেউ। দুইমাস পরে আসাদের জায়গায় এল নাশিদ। আসাদের ডেস্কে বসল। মেয়েটার অদ্ভুদ সুন্দর গানের গলা। কাজের ফাঁকে হঠাৎ সে গেয়ে ওঠে দুয়েকটা লাইন। সুরে ভরে যায় অফিস। সে গানে ভর করে আরো ঘন হয়ে আসে আসাদের না থাকার দুঃখ।
প্রায়ই অফিস শেষে কয়েকজন চলে যায় আসাদের দোকানে। গিয়ে গল্প করে টরে নিজেদের উপহার দেওয়া বই ফের কিনে নিয়ে আসে। আর কেউ আসাদের দোকানে আসে না তেমন। কিন্তু আসাদের মেয়ে নিহারিকা সারাদিন দোকানে বসে বসে বাবার সঙ্গে বই পড়ে। তিন বছর বয়স না হতেই সে অক্ষর চিনে গেছে। সকালে গোসল করে সেজেগুজে বাবার সাথে দোকানে আসে সে, বাসা থেকে নিয়ে আসা দুপুরের খাবার বাপ বেটি মিলে দোকানেই খেয়ে নেয়। খুব সুখে আছে মেয়ে, বোঝা যায়। কিন্তু আসাদের দোকান ভাড়া ওঠে না। বউয়ের সরকারি ব্যাংকের বেতনে সংসার চলতে চায় না। দিন দিন চিন্তার ভাঁজ বাড়তে থাকে আসাদের কপালে। এবার দুই রুমের বাসা ছেড়ে, পুরান এক বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার এক রুমের বাসায় উঠে গেল তারা। সঞ্জয় একদিন বলল, ‘আসাদ, অফিসে জয়েন করো আবার। সম্পাদকের সঙ্গে আমি কথা বলব, রাজি করাব।’ আসাদ বলল, ‘না, সঞ্জয়দা, মেয়েকে ছেড়ে এক মুহূর্ত অন্য কোথাও যাব না আমি।’
পরে একদিন জিনাত বুদ্ধি দিল, বই আর সিডির পাশাপাশি একটু কফির ব্যবস্থা আর বসার জায়গা করলে লোকজন আসবে মনে হয়। অফিসের সবাই মিলে চাঁদা তুলে আসাদের দোকান নতুন করে সাজাল। প্রেমের কবিতার বই আর ভ্যালেন্টাইন কার্ডও রাখা হলো। ফেব্রুয়ারিতে ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে লাগল আসাদের ‘নিহারিকা বই বিতান’-এ। আসাদের নিহারিকাও বাবার সঙ্গে খুব ব্যস্ত হয়ে দোকান সামলাতে শিখে গেল। অফিসের কলিগরা প্রায়ই বন্ধু বান্ধব নিয়ে আসে। ভিড় দেখে জিনাত বলল, ‘আরেকজন স্টাফ লাগবে এবার। আর মেয়ে স্কুলে দিবি না? ও কি দোকানদারিই করবে?’ কিছু বলে না আসাদ, কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হয়, মেয়েকে স্কুলেও দেবে না সে।
আসাদের মেয়ে নিহারিকার পাঁচ হলো। বউয়ের প্রমোশন হলো, আর দোকানও ভালো চলছে দেখে শংকরে দুই রুমের একটা বাসায় উঠে গেল তারা।
নিহারিকা বই বিতানের নতুন স্টাফ হয়ে এল কল্পনা। কল্পনা চাকমা, লালামাটিয়া কলেজে পড়ে, বাংলায় অনার্স, ফার্স্ট ইয়ার। নাম কল্পনা চাকমা শুনে সবার একবার করে হারিয়ে গিয়ে আর কখনও না ফেরা কল্পনা চাকমার কথা মনে পড়ে। বাংলায় পড়ে শুনে সঞ্জয় সেদিন বলেছে, ‘কল্পনাকে আমি একসেট রবীন্দ্রনাথ গিফট করব।’ কল্পনা হাসতে হাসতে বলেছে, ‘না না, অত পড়তে পারব না দাদা, আপনি বরং দোকানে দিয়ে দেন।’ মেয়েটাও দোকানটা খুব ভালোবাসে।
দুপুরবেলা আসাদ বলেছে কল্পনাকে, ‘নিহারিকাকে নিয়ে খেয়ে নাও।’ কল্পনা খাবার রেডি করছিল, এমন সময় বাইরে খুব হইচই শোনা গেল। আসাদ দোকানের বাইরে এসে পাশের দোকানের রফিককে ডাক দিয়ে বলল, ‘কী হইছে রফিক ভাই, বাইরে হৈচৈ কিসের?’ রফিক বলল, ‘এক্সিডেন্ট হইছে। রিকশা উল্টাইয়া পড়ছে মা-বেটি।’ আসাদ এক দৌড়ে রাস্তায় নেমে এল, চার-পাঁচ বছরের মেয়ে কোলে চিৎকার করে কাঁদছে এক মহিলা। মেয়ের মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। দেখে আসাদের মাথা ঘুরে উঠল। কিন্তু নিজেকে সামলালো সে, এখন কিছুতেই অজ্ঞান হওয়া চলবে না। আসাদ দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে কোলে নিল। চিৎকার করে একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে উঠে বসল, মেয়ের মা পাশে বসতেই রিকশাওয়ালা বলল, ‘বাংলাদেশ মেডিকেল যামু, ভাইজান?’ আসাদের মনেই ছিল না রিকশাওয়ালাকে গন্তব্য বলতে হবে। বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ যাও।’ হাসপাতাল কাছেই, তবু দুপুর বেলার ধানমন্ডি সাতাশের জ্যাম ঠেলে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগল। আসাদের মনে হলো, এর চেয়ে হাঁটলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যেত। মেয়ের মা কেঁদেই যাচ্ছে, কেঁদেই যাচ্ছে। হাসপাতালে পৌঁছে মেয়েটাকে ভর্তি করিয়ে মেয়ের মাকে বলল, ‘ওর বাবাকে ফোন করবেন না?’ মহিলা বলল, ‘ব্যাগে ফোন নাই, রিকশা থেকে পড়ার সময় পড়ে গেছে মনে হয়।’ আসাদ নিজের ফোনটা দিয়ে বলল, ‘আপনি ফোন করেন, আমি দোকানে আমার মেয়েকে রেখে আসছি, ওকে নিয়ে আবার আসতেছি।’
সঞ্জয়দা, কারা যেন কল্পনাকে তুলে নিয়ে গেছে, আমি মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে।
প্রায় দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে। আবার পড়িমড়ি করে দোকানের দিকে রওনা হলো সে, গত তিন বছর কখনও এতটা সময় মেয়েকে ছেড়ে থাকে নাই সে। রিকশা থেকে নামতে নামতেই দেখতে পেল মার্কেটের সিড়িতে দাঁড়িয়ে আছে রফিক, রফিকের েেক্লা নিহারিকা, গল গল করে রক্ত পড়ছে মেয়ের মাথা থেকে। রফিক বলল, আসাদ ভাই, ‘পিস্তল-চাপাতি নিয়া কারা জানি আপনের দোকানে আইসা কল্পনারে তুইলা নিয়া গেছে! আমরা কেউ আগাইতে সাহস পাই নাই, আর আপনের মাইয়ার কী সাহস, হে কিছুতেই কল্পনারে ছাড়তেছিল না।’ রফিক কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘হেরা মাইয়ার মাথায় বারি মারছে, আসাদ ভাই!’
মেয়ে কোলে নিয়ে আবার রাস্তায় নেমে এল আসাদ। আবার রিকশা ডাকল, আবার হাসপাতালে গেল। মেয়েকে স্কুলে তো ভর্তি করে নাই আসাদ, কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করাল, ডাক্তার বলল, দুই মেয়েকে এক কেবিনে দিয়ে দেবে? আসাদ মহিলার দিকে তাকাল, সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। মাথা ব্যান্ডেজ করা দুই মেয়ে কেবিন নম্বর পাঁচ শ এক এর দুই বিছানায় ঘুমিয়ে রইল। মহিলা তখন বলল, ‘ভাই আমার বড় মেয়ের ইস্কুল ছুটি হইছে, আমি ওকে বাসায় দিয়া আসতেছি, ওদের বাবা গেছে বরিশাল, রওনা দিছে।’ রফিক মাথা নাড়ল, মহিলা ফোনটা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আসাদ সঞ্জয়কে ফোন করে বলল, ‘সঞ্জয়দা, কারা যেন কল্পনাকে তুলে নিয়ে গেছে, আমি মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে।’ আসাদের মেয়ে হাসপাতালে হলে, আসাদের কী অবস্থা জানে সঞ্জয়, সে জেরা করল না। কল্পনার ছবি নিয়ে থানায় ছুটল সঞ্জয়।
নিহারিকার মায়ের আজ বছরের শেষ অফিস, ব্যাংকারদের ইয়ার এন্ডিং। সকালে বলে গেছে, ‘আজ খুব ঝামেলা, ফিরতে দেরি হবে, ফোনও সাইলেন্ট থাকবে। বাসায় ফিরে খেয়ে নিহাকে ঘুম পাড়িয়ে দিও।’ মেয়ে বাবার সঙ্গে থাকে বলে খুব নিশ্চিন্তে থাকে সে। বউকে ফোন করবে কিনা বুঝে উঠতে পারে না আসাদ।
একটু ঝিমুনি মতো এসেছিল আসাদের। চোখ খুলে দেখল, মেয়েরা ঘুমায়, স্যালাইন চেক করল, ঠিক আছে। ফোন চেক করে দেখল, দুইটা বার্তা। একটা নিহারিকার মায়ের : ‘আম্মার শরীর ভালো না, আজ আম্মার বাসায় থাকব, তোমরা খেয়ে, ঘুমিয়ে পড়ো।’
আরেকটা মনে হয় অন্য মেয়েটার মায়ের : ‘ভাই, আমার হাজব্যান্ড বরিশাল থেকে আসার সময় এক্সিডেন্ট করেছে, মেয়েটাকে দেইখেন, ভাই!’
রাত হয়ে আসে। রাত গভীর হয়। সব শব্দ কমে আসে। এই শহরে গভীর রাতের শব্দ ইট আর বালু নামানোর শব্দ। সে শব্দে দুটি আহত শিশুর মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ ঢেকে যায়।