রাষ্ট্রীয় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যশোরের মণিরামপুরে অবৈধভাবে একের পর এক ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গড়ে ওঠছে। এভাবে গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গুলোর অধিকাংশরই নেই কোন নিয়মনীতি, নেই কোন সরকারি অনুমোদন। শুধুমাত্র অনুমোদনের জন্য অনলাইনে আবেদন করে, আবার কোন প্রতিষ্ঠান কোন কিছু না করেও বহাল তবিয়তে দীর্ঘদিন ধরে ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়মনীতি না থাকার কারণে এসকল প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজনরা নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন, আবার কেউবা লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানাযায়, দেশের অন্যতম বৃহত্তম উপজেলা মণিরামপুর। ১৭টি ইউনিয়ন ও একটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভার ২’শ ৬২টি গ্রামে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ বসবাস করেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও শ্রমজীবি। বৃহত্তম এ জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্যসেবার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেই কোন উপকরণ, নেই এক্স-রে মেশিন, আল্ট্রাসনো মেশিন, ইসিজি মেশিন, এমনকি রক্তের গ্রুপ নির্নয়ের রিয়েজেন্টও নেই, রোগী বহনের জন্য মান্দাতার আমলের একমাত্র অ্যাম্বুলেন্সটি বছরের ছয় মাস থাকে গ্যারেজবন্দী। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, যা আছে তারাও ব্যক্তিগত প্রাকটিস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
এ সকল কারণে একের পর এক ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গড়ে ওঠছে। এদিকে, স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা গ্রামের সহজ-সরল রোগী ও রোগীর স্বজনরা বাধ্য হয়ে ক্লিনিকে ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে গিয়ে, আবার কখনও কথিত ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের পালিত দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন, আবার কেউবা লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, অত্র উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৮টি ক্লিনিক ও ১৪টি ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গড়ে ওঠেছে। ক্লিনিকগুলো হলো-মনোয়ারা ক্লিনিক, মুন হসপিটাল, ফাতেমা ক্লিনিক, বোরহান উদ্দীন সার্জিক্যাল, তফি ক্লিনিক, কপোতাক্ষ সার্জিক্যাল, রোকেয়া ক্লিনিক ও রিজু হসপিটাল এবং কপোতাক্ষ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, জিনিয়া প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরী, সেবা ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, দি-প্যাথ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, ল্যাব-সাদ মেডিকেল সার্ভিসেস, মেডিকো ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, রাজগঞ্জ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, ডক্টরস ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, প্রগতি ডিজিটাল ডি-ল্যাব, মুন ডায়াগনিষ্টক সেন্টার, সেফ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, নিউ লাইফ ডায়াগনষ্টিক এ- কনসালট্যান্ট সেন্টার, তফি ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, বোরহান উদ্দীন ডায়াগনষ্টিক সেন্টার।
এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনটির হালনাগাদ রেজিষ্ট্রেশন নেই, শুধুমাত্র অনলাইনে আবেদন করা হয়েছে। তাছাড়া কপোতাক্ষ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, নিউ লাইফ ডায়াগনস্টিক এ- কনসালট্যান্ট সেন্টার, সেফ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, রাজগঞ্জ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, কপোতাক্ষ সার্জিক্যাল, ফতেমা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোন ধরনের আবেদন ছাড়ায় স্বাস্থ্যসেবা কার্য্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বোরহান উদ্দীন সার্জিক্যাল ও বোরহান উদ্দীন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে চিকিৎসক না থাকায় বর্তমানে বন্ধ আছে।
অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসকল প্রতিষ্ঠানে নেই কোন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত নার্স, নেই আধুনিক উপকরণ, নেই কোন আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার। ফলে সেবা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজনরা প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত, ঠকছেন বারংবার। কখনও বা লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন কেউ কেউ।
সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের চোখে ধূলো দিয়ে দিনের পর দিন অন্যায় করে চলেছে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলো। সম্প্রতি মণিরামপুর পৌর শহরের পাইলট হাইস্কুল সংলগ্ন মনোয়ারা ক্লিনিকে ভূল অপারেশনে এক প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে গত ১৯ এপ্রিল মণিরামপুর থানায় ওই মালিকের বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। বর্তমানে ওই সার্জিক্যাল মালিক জেল-হাজতে আছেন এবং প্রশাসন ওই ক্লিনিকটি সিলগালা করে রেখেছেন।
ভূক্তভোগী রোগীর স্বজন উপজেলার স্বরুপদহ গ্রামের আতিয়ার রহমান বলেন, মনোয়ারা ক্লিনিকের দালালের খপ্পরে পড়ে আমার প্রসূতি বোনকে গত বছর এই সময় মনোয়ারা ক্লিনিকে ভর্তি করি। ভুল অপারেশন করার কারণে আমার বোন মারা যায়। বিশিষ্ট উন্নয়নকর্মী ও মণিরামপুর উপজেলা শুভসংঘের সভাপতি মোঃ শফিকুজ্জামান বলেন, ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখানকার কোন প্রতিষ্ঠানে আবাসিক বা জরুরি কোন চিকিৎসক নেই, নেই কোন প্রশিক্ষিণপ্রাপ্ত টেকনেশিয়ান বা নার্স। ফলে সেবা নিতে এসে রোগী ও রোগীর স্বজনরা হচ্ছেন প্রতারিত। প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারিই পারে এগুলো রোধ করতে।
মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শুভ্রা রাণী দেবনাথ বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য সেবার ঘাটতির কারণে বাইরে ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার স্থাপিত হচ্ছে তা সঠিক নয়। তবে জনবল ও চিকিৎসক সংকটের কারণে বৃহৎ এ জনগোষ্ঠির পুরোপুরি স্বাস্থ্য সেবা দিতে একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে।
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ শরিফী বলেন, চিকিৎসা সেবার নামে মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি করা বরদাশত করা হবে না। এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
যশোরের সিভিল সার্জন ডা. দিলীপ রায় বলেন, অবৈধভাবে ক্লিনিক বা ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গড়ে ওঠার কোন সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে প্রশাসনের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কেউ লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ করলে তদন্তপূর্বক আইনানুগ পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।