জেলার ১০টি খাদ্য গুদাম থেকে প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ টাকা মূল্যের চাল ও গম ওজনে কম দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনি, সামাজিক সংগঠন ও খাদ্য বিভাগের ডিলাররা। অবশ্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা এ অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন।
অভিযাগগুলো বরিশাল জেলার খাদ্য গুদামের দায়িত্বরত ওসিএলএসসি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই বেশি। ওইসব কর্মকর্তাদের সম্পদের সুষ্ঠু তদন্ত হলে বেরিয়ে আসতে পারে থলের বিড়াল। সূত্রমতে, ওইসব কর্মকর্তাদের মাসিক বেতন ২২ থেকে ৩০ হাজার টাকা হলেও তাদের বেশির ভাগ কর্মকর্তারাই ২/৩ বছর একটি গুদামের দ্বায়িত্ব পালন করেই নতুন জমি ক্রয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আর এসব টাকার সবই অসাধু পন্থায় আয় করা হচ্ছে বলেও সূত্রগুলো দাবি করে দুনীর্তি দমন কমিশনকে ওইসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিবীর তদন্তের দাবি করেছেন।
সূত্রমতে, খাদ্য গুদাম থেকে চাল ও গম দেয়ার সময় অত্যন্ত কৌশলের মাধ্যমে প্রতি টন চাল ও গমে ৪০ কেজি মাপে কম দেয়া হয়। গুদামের বৈদ্যুতিক মাপক যন্ত্রের সাহায্যে সু-কৌশলে চাল ও গম ওজন করে দেয়ার সময় প্রতি বস্তায় এক থেকে তিন কেজি করে কম দেয়া হয়। মাপক যন্ত্রের বিশেষ পদ্ধতি থাকায় ৫০ কেজি ও ৩০ কেজির বস্তায় সব সময় বাড়তি দেখানো হয়।
সূত্রে আরও জানা গেছে, মালামাল গুদাম থেকে বিতরণের সময় একটি বা দুটি বস্তা মাপ দিয়ে বাকি বস্তাগুলো ওই হিসেবে দেয়া হয়। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের এক তথ্যে দেখা গেছে, বরিশালের ১০টি উপজেলার ১০টি খাদ্য গুদাম থেকে চাল ডেলিভারী দেয়া হয়েছে ৩৩ হাজার ৯৬৬ মেট্রিকটন ২৭২ কেজি। প্রতি টন সরকারী মূল্যে ৪২ হাজার টাকা হলে ডেলিভারী দেয়া চালের মূল্য চার কোটি ৬৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। আর গম দেয়া হয়েছে-দুই হাজার ৮৬৯ মেট্রিকটন ৯৯ কেজি। গমের প্রতিটন সরকারী মূল্যে ২৯ হাজার টাকা হিসেবে মোট মূল্য দাঁড়ায় আট কোটি ৩২ লাখ এক হাজার টাকা। অর্থাৎ বরিশালের ১০টি খাদ্য গুদাম থেকে বিভিন্নখাতে চাল ও গম দেয়া হয়েছে ৫০ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার টাকার। এক বছরে ডেলিভারী দেয়া চাল থেকে ১৩৩ মেট্রিকটন কম দেয়া হয়েছে অর্থাৎ প্রতিটনে ৪০ কেজি কম দেয়ায় এ চালের সরকারী হিসেবে মূল্য দাঁড়ায় ৫৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। আর গম কম দেয়া হয়েছে প্রায় ১২ মেট্রিক টন। ২৯ হাজার টাকা প্রতিটিন হলে এর মূল্য দাঁড়ায় তিন লাখ ৪৮ হাজার টাকা। পাশাপাশি এই সময়ে ১০টি গুদামে চালের ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৬৮ মেট্রিকটন ১৮৫ কেজি। যার প্রতিকেজি ৪২ টাকা হলে মোট মূল্য দাঁড়ায় তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর গমে ঘাটতি দেখানো হয়েছে নয় মেট্রিকটন ২২০ কেজি। ২৯ টাকা সরকারী প্রতি কেজির মূল্য হলে এর দাম দাঁড়ায় দুই লাখ ৬৭ হাজার ৪৫২ টাকা।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গুদামগুলোতে যে ঘাটতি দেখানো হয়েছে বরিশাল জেলায় এ ধরনের ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। কারণ বরিশালে নৌপথে চাল ও গম আনা হয়। জলীয়বাস্পের কারণে চাল ও গমের কমতি হয় না বরং বাড়ে। সেখানেও শুভংকরের ফাঁকি দিয়ে ওসিএলএসডি কর্মকর্তারা কয়েক লাখ টাকা নিজেদের পকেটে ভরে নেয়। এসব ব্যাপারে কেউ কখনো অভিযোগ দায়ের করলেও রহস্যজনকভাবে কোন তদন্ত শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত রূপ নিতে পারেনা।
জেলার অসংখ্য জনপ্রতিনিধিরা জানান, গুদাম থেকে চাল ও গম নেয়ার পর বাহিরে গিয়ে মাপ দিলেই কম হয়। তাই বাধ্য হয়েই যাদের মধ্যে ওইসব মালামাল দেয়া হয়। তা সব সময়ই তারা কম দিতে বাধ্য হন। এ কারণে চলতি বছর জেলার গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি (১০ টাকার চাল) ডিলারের ডিলারশীপ বাতিল করা হয়েছে। ওই ডিলারশীপের পরিচালনাকারী সাবেক ইউপি সদস্য জাকির হোসেন অভিযোগ করেন, খাদ্য গুদাম থেকে ৩০ কেজির বস্তার চাল দেয়া হয়েছে। সেই বস্তা গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এতে দেখা গেছে প্রতিবস্তায় দুই থেকে তিন কেজি করে চাল কম হচ্ছে। এনিয়ে গ্রাহকরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ দায়ের করলে কোন কারণ দর্শানো ব্যতিরেখেই তার ডিলারশীপ বাতিল করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে খাদ্যগুদাম থেকেই প্রতিবস্তায় তাকে ২/৩কেজি করে চাল কম দেয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, জেলার ১০টি উপজেলার ১০টি খাদ্য গুদাম থেকে প্রতিবছর কাবিখা, ভিজিডি, ভিজিএফ, ফায়ার সার্ভিস, কারাগার, র্যাব, পুলিশের বিভিন্ন দপ্তর, ভিজিএফ (মৎস্য) বিশেষ খাদ্য কর্মসূচি, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, (১০ টাকার চাল), ঈদ, কোরবানী, দূর্গাপুজা, বড়দিনের বিশেষ বরাদ্ধ ও জিআর চাল-গম দেয়া হয়।
বরিশালের মুলাদী উপজেলার বাটামারা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম, সফিপুরের ইউপি চেয়ারম্যান আবু মুসা হিমু, নাজিরপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন পন্ডিত, বাকেরগঞ্জের দাঁড়িয়াল ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার বাবুল, মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার চরগোপালপুর ইউপি চেয়ারম্যান সামসুল বারী মনির, আলিমাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান শেখ সহিদুল ইসলাম, শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান হারুন মোল্লা, জাঙ্গালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কাদের ফরাজীসহ অসংখ্য ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা অভিযোগ করেন, খাদ্য গুদাম থেকেই তাদের চাল ও গম ওজনে কম দেয়া হয়। ইউপি চেয়ারম্যানরা আরও বলেন, প্রতিটন চাল ও গমে ৪০ কেজি থেকে ৬০ কেজি পর্যন্ত কম দেয়া হয়। তারা অভিযোগ করেন, চাল ও গম চুরি করে সরকারী খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। আর দোষারোপ করা হয় জনপ্রতিনিধি ও ডিলারদের।
এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) অবনী মোহন দাস বলেন, জনপ্রতিনিধি ও ডিলারদের অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। তবে কিছুটা ঘাটতি হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।