মাঝে মধ্যে আমাদের প্রিয় দেশটাকে নিয়ে হতাশ ও নিরাশ হতে হয়। কতিপয় শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, ধনকুবের দ্বারাও যখন দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয় ও রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরুপের খবর আমরা দেখে থাকি, শুনে থাকি; তখন মনবেদনা নিয়েও ভাবতে হয়, পৃথিবীর সর্বত্র যখন এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা তখনও পিছিয়ে যাচ্ছি! কিন্তু না! সারা দেশ যখন ‘ফণীর’ ভয়ঙ্কর ছোবলের আতঙ্কে আতঙ্কিত ছিল, এর মাঝেই আমাদের আশা ও আলো দেখিয়েছেন, ‘দেশ বিপ্লবের’ সমূহ সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছেন রাজশাহীর আড়ানীর হোটেল ব্যবসায়ী বিপ্লব সরকার নামের এক যুবক।
বিপ্লবের এসএসসি পরীক্ষাটা দেয়া হয়নি। লেখাপড়া না করে কী ভুল করেছেন এখন তিনি বুঝতে পারেন। এজন্য যে বাচ্চারা লেখাপড়া শিখছে, তারা যেন শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে, তার জন্য তিনি তার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারছেন, সহযোগিতা করছেন।
গায়ে স্কুল ড্রেস আর পকেটে পাঁচটি টাকা থাকলেই বিপ্লবের হোটেলে দুপুরে ডালভাত খাওয়া যায়। শুধু স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরে ভাত খাওয়ার এই ‘পাঁচ টাকার প্যাকেজ’ গত তিন বছর ধরে চালু রেখেছেন বিপ্লব সরকার। শ্যামল সরকারের ছেলে বিপ্লবের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পূর্বপাড়া মহল্লায়। ‘অন্নপূর্ণা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ নামে আড়ানী বাজারের তালতলায় বড়াল নদের ধারে বিপ্লব সরকারের হোটেল। আড়ানী মনোমোহিনী সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই হোটেলে পাঁচ টাকায় দুপুরের খাবার সেরে নেয়। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় কুমার এই পাঁচ টাকার প্যাকেজ সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তিনি তার স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শোনার পরে একদিন দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি দেখে অবাক হয়েছেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ, সাধুবাদ, স্যালুট, বিপ্লব সরকারকে। বিপ্লবরা আজো আছে বলেই পৃথিবীটা এখনও এত সুন্দর। কে বলেছে বিপ্লব শিক্ষিত নয়? রবং স্বশিক্ষায় শিক্ষিত বিপ্লবের কর্ম, জ্ঞান, অনেক অনেক ডিগ্রি ও ডক্টরেটধারীদের থেকেও সমুন্নত। আমাদের মানসিকতা বিপ্লবের পর্যায়ে পৌঁছতে পারলে দেশের অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। বিপ্লব বলেন, ‘মনের আনন্দেই এটা করছি, সেবার মানসিকতা থেকে করছি।’ রেয়ার হইলেও পিওর সাদামনের নিঃস্বার্থ ভালো মনের মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছে। যাদের কারণেই হয়তো পাপ আর পাপীতে পূর্ণ এই দুনিয়ার অস্তিত্ব এখনো আছে! মন ছুয়ে যাওয়ার মতো মানবতার অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী বিপ্লবের প্রতি তার কর্ম গুণেই শ্রদ্ধা চলে আসে। বিপ্লব সম্পর্কে কোন মন্তব্য করার মতো যোগ্যতাই আছে বলে মনে করছি না! এ কাজ করতে শুধু ভালো মনই নয়, বিশাল সাহসও লাগে! ব্যাপক ধন-দৌলতধারী মানুষ অপেক্ষা বড় মনের মানুষই উত্তম, বিপ্লবই তার উদাহরণ। মানুষের সম্মান, মর্যাদা বয়স ও সম্পদ থেকে নয়; আচরণ ও কার্য থেকেই আসে। মানুষের কল্যাণে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে বিত্তশালী হওয়াটাই বড় কথা নয়। আগে আমাদের মনটা উদার হতে হবে।
এ দেশের তথাকথিত অভিজাত ভদ্রলোক, কোটিপতিদের মানসিকতা যদি এরকম হতো, তাহলে কতই না ভালো হতো! বিপ্লবইতো সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক, শিক্ষানুরাগী, অনুকরণীয়, অনুসরণীয়, মানবিক ও আদর্শিক দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মানুষপ্রেমী সাহসী যুবক। যারা নীরবে-নিভৃতে, উদার মানসিকতা নিয়ে মহৎ কাজ করে চলেছেন। বিপ্লবের সামর্থ্য কম, কিন্তু ইচ্ছা, চেষ্টা, বাসনা পাহাড়সম। একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে অসাধারণ হয়ে উঠে বিপ্লব তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সবাই এভাবে এগিয়ে আসলে দেশটা খুব তাড়াতাড়ি বদলে যেতে পারে! এভাবেই আমরা একদিন পাল্টে যাবো, আর পাল্টে যাবে এ দেশ, এটাই আমরা বুঝতে চাই, ভাবতে চাই, বিশ্বাস করতে চাই।
বিপ্লব সরকার বলেন, ‘গ্রামের অধিকাংশ বাচ্চাই বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসে না। অনেকের বেশি টাকা দিয়ে হোটেলে দুপুরের খাবার কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্যও নেই। তারা স্কুলে এসে টিফিনের সময় আশপাশের দোকান থেকে মুখরোচক কিছু একটা কিনে খায়। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। অথচ দুপুরে এক প্লেট ভাত খেতে পারলে তাদের শরীরটা ভালো থাকে। এই চিন্তা থেকেই বাবার অগোচরে পাঁচ বছর আগেই তিনি এই প্যাকেজ চালু করেন। তখন থেকেই বাচ্চারা খেতে আসতে শুরু করে। তবে তার বাবা দুই বছর পর বিষয়টি জানতে পারেন। তবে তিনি এতে বাধা দেননি।’
স্কুলের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে কতজনইতো বিক্রি করে ইয়াবাসহ সব ভয়ংকর নেশা! গত ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম শিকদার বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থীরাই বেশি ইয়াবা সেবন করে’। ইতোপূর্বের এ খবরও আমরা শুনেছি, ড্যান্ডি নেশায় আক্রান্ত মানিকগঞ্জের প্রাইমারি স্কুলের কোমলমতি শিশুরা। বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি দোকানে স্থানীয় শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর কাছে ড্যান্ডি বিক্রির সময় পৌরসভার কান্দা পৌলী গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বিল্টুকে ১৬৫ পিস ড্যান্ডিসহ আটক করে মানিকগঞ্জ ডিবির স্পেশাল স্কোয়াডের সদস্যরা। এ ঘটনায় মানিকঞ্জের পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আটককৃত বিল্টু শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে এই ড্যান্ডি বিক্রি করে থাকেন। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাব্বির ও সুমিকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হলে জানায়, বিল্টুর দোকান থেকে তারা ড্যান্ডি কিনে নেশা করে থাকে। দুই শিশুর মতে, মানিকগঞ্জে অনেক শিশু শিক্ষার্থী এই ড্যান্ডি নেশায় আক্রান্ত।
বিপ্লবও ব্যবসা করছেন, আর মাদক কারকারীরাও ব্যবসা করছেন। বর্তমানে পবিত্র রমজান চলছে, রমজান মাসে আজ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। সেহরি, ইফতারিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের পেটভরে খাওয়ারও সুযোগ নেই। দ্রব্যমূল্য আকাশছোয়ার বছরব্যাপী অবশ্যম্ভাবী নিয়তি ও অভিন্ন দুর্ভোগের মাত্রা রমজানে অসহনীয় হয় খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। সবার সামর্থ্য সমান নয়, অনেকে রোজা রেখে ইফতারসামগ্রী জোগাড় করতে হিমশিম খায়। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয় স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ। মুসলিম হিসেবে আসলেই আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংযমের মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস করে জনগণের সেবা করা হয়। আমাদের দেশে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত। রমজান এলেই দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া! যা যুগ যুগ ধরে চলমান। অথচ রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়ে রাখার বক্তব্য, আলাপ ও নির্দেশ শোনা যায়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বাজারে খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ থাকার পরও কেন পণ্যের দাম বারে, তা অনুসন্ধান ও প্রতিকার করা কি কোন সরকারের সাধ্য, সামর্থ ও শক্তির বাইরে?
যে সময়ে শহরের ফুটপাতে এককাপ রং চা খেতে ১০ টাকা লাগে, সেই যুগে ৫ টাকায় স্কুলের বাচ্চাদের দুপুরের খাবার খাইয়ে পুুরো বাংলাদেশকে বিপ্লব দেখিয়ে দিয়েছে! হরতাল, ধর্মঘট, আমরণ অনশন, আন্দোলন, এটা চাই, ওটা চাই, আমাদের দাবি মানতে হবে, ইত্যাদি সারা জীবন ধরে আমরা শুনছি। কিন্তু এসব না করেও বিপ্লবের মত অল্প কিছু মানুষ একটা দেশকে অনেক উপরে নিয়ে জেতে পারে। বিপ্লবই তার বাস্তব উদাহরণ।
বিপ্লব সরকার বলেন, ‘বাচ্চাদের তিনি কয়েকটি শর্তে খেতে দেন। তার প্যাকেজ খেতে হলে অবশ্যই স্কুল ড্রেস পরে আসতে হবে। আর খাবার আগে বা পরে বাইরের দোকানে অন্য কোনো মুখরোচক খাবার খাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, তিনি দেখেছেন বেশির ভাগ বাচ্চাই এক প্লেটের বেশি ভাত খেতে পারে না। তিনি ভাতের সঙ্গে সবজি আর ডাল দিয়ে একটি প্যাকেজ তৈরি করেছেন। খাবার সময় তিনি খেয়াল করেন, কোনো বাচ্চা যেন সবজি নষ্ট না করে। শরীরের জন্য সবজির বড় প্রয়োজন। তিনি তাদের সবজি খেতে বাধ্য করেন। টমেটোর মৌসুমে টমেটোর সালাদ খেতে বাধ্য করেন। এই প্যাকেজ তিনি পাঁচ টাকায় দেন। তবে পাশাপাশি খেতে বসে কোনো বাচ্চা যদি বেশি টাকা দিয়ে মুরগির মাংস খেতে চায়। তাহলে তিনি পাশের বাচ্চাটাকেও ছোট এক টুকরা মুরগির মাংস ও একটু ঝোল দেন। যাতে তার মন খারাপ না হয়।’
মানবতার কোন সীমানা, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নেই। বিপ্লবকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও শুভ কামনা। বিপ্লবের মতো যুকদের মহতি ও মানবতাধর্মী উদ্যোগের কারণেই, বিপ্লবের মতো মানুষ আছে বলেই এখনো আমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকার, সোনার বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী গর্ব করার অনুপ্রেরণা পাই। এরকম বড় মনের ও হৃদয়ের লোক আছে বলেই দেশকে নিয়ে এখনও আশা আছে। সবকিছু এখনও শেষ হয়ে যায়নি।
বিপ্লব সরকার আরো বলেন, ‘গ্রামের অধিকাংশ বাচ্চাই বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসে না। অনেকের বেশি টাকা দিয়ে হোটেলে দুপুরের খাবার কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্যও নেই। তারা স্কুলে এসে টিফিনের সময় আশপাশের দোকান থেকে মুখরোচক কিছু একটা কিনে খায়। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। অথচ দুপুরে এক প্লেট ভাত খেতে পারলে তাদের শরীরটা ভালো থাকে।’ বিপ্লবের এ কথায় যে কোনো বিবেকবার মানুষই আবেগাপ্লুত না হয়ে পারবেন কী? বিপ্লবের কথাগুলো যে কোন হৃদয়বান মানুষেরই চোখে পানি না এসে পারে না। সেই সাথে মনে করিয়ে দিলো স্কুল জীবনে দল, বেঁধ টিফিন পিরিয়ডে আমরা কিভাবে পোড়াতেলে ভাজা চপ, সমুচা, সিঙ্গারা, ফোঁসকা, দুষিত চর্বিমাখা ঝালমুড়ি ও আচাড় খেতাম। যার ফলে প্রায় সকলেরই অসুস্থতা বোধসহ স্থায়ী এ্যাসিডিটি শরীরে বাসা বেধেঁ রয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও বর্তমানে ওসব খেয়ে সুস্থ থাকার সম্ভাবনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে।
এছাড়াও বগুড়ার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল সারাদিন উন্নতমানের খাবার বিক্রি করার পর রাতে গরিব, ভিক্ষুক, ভাসমান ছিন্নমূল ও অভাবী মানুষদের মুখে বিনামূল্যে খাবার তুলে দেয়ার নজির স্থাপন করে আসছে। বগুড়া শহরের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে অবস্থিত হোটেলটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আকবর আলী মিঞা। হোটেল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ ৯৬ বছর ধরে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে আসছে।
‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য!’ আলোকিত মানুষ বিপ্লব ও বগুড়ার আকবর আলী প্রমাণ করলেন, এ সেøাগান এখনও বেঁচে আছে। তাদের এই মহৎ কাজের দৃষ্টান্ত আমাদের ভেতরে ভালো কাজ করার প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে আশা করি।