শাহিনুর আক্তার তানিয়া পেশায় ছিলেন একজন নার্স। অসুস্থ মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলাই ছিল যার কাজ। মৃত্যুপথযাত্রী কত রোগীকে মৃত্যুমুখ থেকে প্রতিনিয়ত ফিরিয়ে নিয়ে আসেন শাহিনুরেরা। প্রতিদানে ওত পেতে থাকা কতিপয় সুযোগ সন্ধানী নরকের কীটরা তাদের ধর্ষণ করে। শুধু ধর্ষণ করেই তারা ক্ষান্ত হয় না, তারা শাহিনুরদের মাথা থেঁতলে দেয়, তারপর পৈশাচিক উল্লাসে ধর্ষণের শিকার দেহ ছুড়ে ফেলে ঝোপ-জঙ্গলে, নর্দমায় কিংবা মহাসড়কের ঢালে। শাহিনুর গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলো এবং ধর্ষণের পর ধর্ষকেরা ভারী কিছু দিয়ে শাহিনুরের মাথার পেছনে আঘাত করে। এতে শাহিনুরের মাথার পেছনের খুলি ফেটে যায়। ফলে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান শাহিনুর।
গত ৯ মে রাজধানীর কল্যাণপুরে শাহিনুরসহ গণপরিবহনে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে যখন তার সহকর্মীরা ঘৃণায়, ক্ষোভে, দুঃখে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তখন তাদের দিকেও ছিল গণপরিবহনের চালকের সহকারীর তুচ্ছ, তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি। যা দর্শনে সোশ্যাল মিডিয়াসহ সর্বমহলে ব্যাপক নিন্দা ও তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
কতিপয় গণপরিবহন শ্রমিকের মানসিকতা কত নিম্ন, নিচু, ইতর ও অভদ্র প্রকৃতির, তার পরিচয়ই ছবিতে দৃশ্যমান হয়েছে। হায়রে মানবতা! পশুরাও ওদের দেখে লজ্জায় মুখ লুকাবে। সবাই আজ মূক, নির্বাক, স্বরহীন, কি আর বলার আছে! সব ভাষা যেন আজ থেমে গেছে! কী অপরাধ ছিলো শাহিনুরের? মানব সমাজকে সেবা করার বিনিময়ে তার ভাগ্যে জুটলো ধর্ষণ ও মাথার খুলি ফাটিয়ে হত্যা!
উম্মত্ত জানোয়ার ও হায়েনারুপি গণপরিবহন শ্রমিকরা আদিম উল্লাসে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করছে শাহিনুর আক্তার তানিয়াকে। কোনো এক নারী যদি এ দৃশ্যটি চিন্তা করে থাকেন, ভেবে থাকেন; এতে তার বুকের ভেতরের উথাল-পাতালটা কেমন হবে? নিশ্চয়ই তীব্র কষ্টে, ভয়ে, আতঙ্কে, দম আটকে আসবে! চোখ ভিজে যাবে!
সেবার ব্রত নিয়ে প্রতি বছর ১২ মে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবস’। নার্সেস দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নার্সেস : আ ভয়েস টু লিড-হেলথ ফর অল’ অর্থাৎ, ‘নার্সেস বলিষ্ট কণ্ঠস্বর-স্বাস্থ্য মানবিক অধিকার’। কষ্টের ও বেদনার বিষয়, এই মে মাসেই মানব সেবায় নিয়োজিত শাহিনুর আক্তার তানিয়ার ‘বলিষ্ট কণ্ঠস্বর’কে বিষণœ, বিষাদগ্রস্ত করে গণধর্ষিত ও নির্মম মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হলো!
নার্সিং একটি সেবামূলক পেশা। নার্স মানেই মনে ‘সাদা’, পোষাকে সাদা, আচরণ ও কর্মে সাদা। সবকিছুতেই যেন সাদার সমাহার। শান্তির প্রতীক এই সাদাকে তারা মনে, মননে ধারন করে জীবন/ যৌবনকে উৎসর্গ করেন। সেবাই তাদের মূল ধর্ম, সেবাই তাদের ব্রত। রাত নেই, দিন নেই সংসার, পরিবার, সন্তানের মায়াকান্না তাদের সেবাধর্মী মনের কাছে অবহেলিত ও তুচ্ছ। কিন্তু শাহিনুর আক্তার তানিয়া তার সেবার বিনিময় পেলেন ধর্ষণের দ্বারা!
শাহিনুর আক্তার ঢাকার কল্যাণপুরের ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কয়েক দিন আগে শাহিনুরের মা মারা যায়। বাবার সাথে প্রথম রমজানের রোজা রাখতে ৬ মে গ্রামের বাড়িতে আসার জন্য ঢাকার মহাখালী থেকে ‘স্বর্ণলতা’ পরিবহনের বাসে ওঠেন। বাসটি মহাখালী থেকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী হয়ে পিরিজপুর পর্যন্ত চলাচল করে। বাসের লাস্ট স্টপেজ পিরিজপুর থেকে তার বাড়ির দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা।
কটিয়াদীতে আসার পর বাসস্ট্যান্ডে সমস্ত যাত্রী নেমে যায়। গাড়ির চালক এবং হেলপার কৌশলে বাসস্ট্যান্ড থেকে চার-পাঁচজনকে যাত্রীবেশে গাড়িতে তোলেন। এরপর বাসস্ট্যান্ড পার হয়ে দুই কিলোমিটার দূরবর্তী ভৈবর-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের গজারিয়া জামতলী নামক নিরব জায়গায় তাকে ধর্ষণের পর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
মাত্র রাত সাড়ে আটটায় একজন মেয়ের জন্য নিজ বাড়ির অতি নিকটে ভীষণ অনিরাপদ হয়ে গেলো? ১০ মিনিটের দূরত্বেও ওদের ধর্ষণ করার ক্ষমতা রয়েছে! অবশ্য ইতোপূর্বে খবর হয়েছে, খেতে বসা ছয় বছর বয়সী শিশুকেও নরপিচাশেরা টেনে নিয়ে ধর্ষণ করতে পারে।
গণপরিবহনের চালক বা সহকারীদের মধ্যে জীবনবোধ, মূল্যবোধ, মানবতা, লেখাপড়া সবকিছুরই অভাব আছে। চালকদের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত বলে পরিবহনের নেতারাই ইতোপূর্বে স্বীকার করেছেন। বাসচালক, কন্ট্রাক্টর ও হেলপারদের যোগ্যতা সর্বনিম্ন এসএসসি পাস করা জরুরি। যথাযথ পারিশ্রমিক দিয়ে শিক্ষিত যুবকরা গণপরিবহনের হাল ধরলে এই খাতের সার্বিক পরিবেশের উন্নয়ন হবে, পরিস্থিতিও পাল্টে যাবে। বর্তমানে শতশত নতুন বাইকার এবং প্রাইভেট কার চালক যুবকরা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে রাইড শেয়ারিং সিস্টেম- উবার, পাঠাও, অভয়, সহজ ইত্যাদিতে সংযুক্ত হয়ে।
অধিকাংশ চালক, হেলপার অক্ষরজ্ঞানহীন হওয়ার কারণে, মেয়েদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার ‘ভাইরাস’ গণপরিবহন সমাজের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। এ অবস্থা দুর করতে প্রতিটি বাসেই যদি সু-শিক্ষিত স্টাফ নিয়োগ করা হয়, তাহলে ছবিতে যেসব চালক হেলপাররা শাহিনুর আক্তার তানিয়ার সহকর্মীদের মানববন্ধন দেখে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে হাসছিলো, তাদের তখন ভিক্ষা করে খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। মুর্খদের কখনোই বিবেকবোধ তৈরি হয় না। ছোটবেলা থেকেই তাদের ভালো-মন্দ বিবেচনাবোধ থাকে না। তারা শুধু ভোগ করতে চায়, নিজের যেটা পেতে ইচ্ছা করে সেটা পাওয়ার জন্য কোনো ধরনের নৈতিকতার দিকে তাকায় না। ন্যায়-অন্যায়, সামাজিক-অসামাজিক কোনো কিছুই বিচার বিবেচনা ওদের থাকে না। তারা লোভ-লালসা, কামনা, বাসনাকে পূরণ করার জন্য হন্য হয়ে পশুতুল্য রুপ ধারণ করে।
রোগ হলে প্রথম কাজ রোগচিিহ্নত ও সনাক্তকরণ। এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত এবং আন্তরিক চিকিৎসক, রোগ নির্ণয়ের সঠিক ব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতি। তারপর চিকিৎসা। চিকিৎসাও হতে হবে নিবিড় পরিবেশে। তবেই সফলতা আশা করা যেতে পারে। দেশের ধর্ষণ সমস্যার মূল জায়গায় এখনো কেউ হাত দেয়নি! ধর্ষক তৈরি হচ্ছে পর্নগ্রাফির ব্যাপক সম্প্রসারণের পরিণতি হিসেবে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে ধর্ষণ ঘটবার সহজ পরিবেশ, উপায়, উপাত্ত বহাল তবিয়তে রেখে এই পাপ থেকে মানুষ মুক্তি পেরে পারে না।
এজন্য ধর্ষণ কেন বাড়ছে বা ধর্ষণ কেন করা হচ্ছে, এই বিষয়টা নিয়ে ভাবার মতো যথেষ্ট সময় এসেছে। এখনই এই সমস্যা থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হবে। ধর্ষণ মূলত একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। এই বিষয়কে সমাধান করতে হলে মনস্তাত্ত্বিকভাবেই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং মানবিকতার শিক্ষাকে আরো বেশি জাগ্রত ও জোরদার করতে হবে।
আমাদের সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক টিভি প্রচার বন্ধ করতে হবে। এদেশীয় নাটক সিনেমায় এদেশীয় সংস্কৃতিত ও পোশাক ছাড়া বিজাতীয় পোশাক ও আচরণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির চর্চা থাকলে অপরাধীরা বেপরোয়া হবেই। জানা যায়, স্বর্ণলতা পরিবহনের রুট পারমিট নেই। তবুও বছরের পর বছর তারা কিভাবে ওই রুটে বাস চালায়?
গণপরিবহন, বিশেষ করে বাসে ধর্ষণের পর হত্যার তালিকায় রূপা, শাহিনুরসহ একের পর এক নাম যোগ হচ্ছে। ঘটনা ঘটার পর দেশজুড়ে তোলপাড় হলেও ঘটনা থামছে না।
ধর্ষণ এবং সেই সাথে হত্যার অপরাধ বাংলাদেশে সম্প্রতি মহামারী আকারে বেড়ে গেছে। ধর্ষণ বর্তমানে বাংলাদেশের একটা জঘণ্য অধ্যায়ের নাম। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, একজন মেয়ের পিতাকে প্রতিনিয়ত কান আলগা করে অপেক্ষায় থাকতে হবে, তার মেয়ের কোন খবরটা আসছে তার কানে, ধর্ষণ নাকি হত্যা!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন- ধর্ষণ হত্যার মামলাগুলো বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুততার সাথে নিস্পত্তির দ্রুত উদ্যোগ নেয়া হোক।
শুধু ধর্ষণ নয়, গণপরিবহনে নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গত বছর বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা এসেছে, গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময়ে মৌখিক, শারীরিক বা অন্যভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
সংবাদপত্রে সব ঘটনা আসে না, প্রকৃত ঘটনার ভয়াবহতা আরও বেশি। গণমাধ্যম তোলপাড় করলে যা একটু কাজ হয়। মিডিয়ায় পরিচিত কারো মাধ্যমে প্রচারণা না পেলে বিচার দূরে থাক, ধর্ষীতার উল্টো হেনস্থা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এ দেশে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা এত তীব্র হয়েছে সুবিচারের অভাবে। গত বছর চালানো এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ধর্ষণ, যৌন পীড়নের মতো ৬টি নির্দিষ্ট অপরাধে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলায় ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রে সাজা হয়নি। ২০০২ থেকে ২০১৬ সালে দায়ের করা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে এই ফলাফল পাওয়া গেছে। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যা মামলার তদন্ত তিন বছরেও শেষ হয়নি। এমনকি ওই মামলার আসামি আজও শনাক্ত হয়নি।
এর আগেও আমরা দেখেছি- ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী রূপা খাতুনকে ধর্ষণ শেষে তার ঘাড় মটকে হত্যা করে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর বন এলাকায় ফেলে রেখে গিয়েছিল বাসের চালক, হেলপার ও তাদের অন্যান্য সহযোগীরা। ২০১৫ সালে মে মাসে কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরার পথে রাজধানীতে গণধর্ষণের শিকার হন পোশাকের দোকানে কাজ করা এক গারো তরুণী। কুড়িল বাসস্ট্যান্ড থেকে তাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে একদল দুর্বৃত্ত। জানা যায়, শুধু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষী হচ্ছে না বলে মামলাটি ঝুলে আছে। একই বছর বরিশালের নথুল্লাবাদে সেবা পরিবহনের একটি বাসে কুয়াকাটা থেকে আসা দুই বোনকে ধর্ষণ করে গাড়িচালক ও তার সহকারীরা।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ৮ দিনে সারা দেশে ৪১ শিশু ধর্ষণ ও ৩ শিশু ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। এ বছরের মে মাসের ১ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩৭টি মেয়েশিশু ধর্ষণ এবং ৪টি ছেলেশিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল ৩ জনের ওপর। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ৩টি মেয়েশিশু। আহত হয়েছে ৪১ শিশু।
জীবিকার তাগিদে, রোজগারের আশায় অনেক নারীকে কাজ করতে হয় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। চড়তে হয় গণপরিবহনে। কিন্তু তার জন্য তাকে কি যৌন নিগ্রহের শিকার হতে হবে? এজন্য কি তাকে ধর্ষণ করে তার ঘাড় মটকে হত্যা করা হবে? মানব সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে যদি আমাদের সমাজে নারী নিরাপদ না থাকতে পারে তাহলে এই সভ্যতাকে আমরা কিসের সভ্যতা বলবো! যেখানে নারী-পুরুষ মিলে সমাজ এবং জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেখানে পুরুষের কাছে নারীকে লাঞ্চিত হতে হচ্ছে। এসব নারীরা তাহলে কত অসহায়!