কৃষকের সোনার ফসল ঈদের আগে ঘরে তুলতে দেখে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছেন লালমনিরহাট জেলার সাধারন কৃষকগণ। আশা ছিল এই ধান বিক্রি করে পরিবারের সবাইকে ঈদে নতুন পোশাক কিনে দেবেন কৃষকরা। ধুমধাম করে ঈদ করার ইচ্ছা ছিল কৃষকদের। কিন্তু বিধিবাম কষ্টের ফসলের ন্যায্যমুল্য না পেয়ে আসন্ন ঈদ আনন্দও নিরানন্দে পরিনত হয়েছে জেলার কৃষকদের।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের নীচপাড়া এলাকার কৃষক আমজাদ হোসেন জানান, আমরা জানি বর্তমানে তাদের মতো কৃষকের কোন মুল্য নাই। এজন্য তাদের আবাদী ফসলেরও কোন দাম নাই। স্ত্রী সন্তান, বাবা-মা মিলে ৬সদস্যের পরিবার তার। তার ইচ্ছে ছিল এবার ঈদে তার আবাদী সোনালী ফসল ধান বিক্রি করে পরিবারের ভালভাবে ঈদ উদযাপন করবেন। কিন্তু বর্তমানে ধানের ন্যায্য মুল্য না পাওয়ায় তার সে আশায় গুড়ে বালি। তিনি যতগুলো ধান পেয়েছেন সব ধান বিক্রি করেও ঈদের জন্য নতুন কাপড় কেনা হচ্ছে না তার। তাই যদি সে করে, তাহলে পরিবারের খাদ্যের যোগান আসবে কিভাবে.? এই বিষয়টাও তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। শুধু স্ত্রীর জন্যই একটি শাড়ি কিনতে তার ধান বিক্রি করতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই মন।
আমজাদ হোসেন আরো জানান, কঠোর পরিশ্রম করে এবারে তিনি ২৫শতাংশ জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। এবার আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় ফলনও বাম্পার হয়েছে। আর মাত্র কয়েকদিন পর ঈদ। ঈদ আসার আগেই ধান ঘরে আসার মহাখুশি হয়েছিলেন তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু সেই ধান ঘরে উঠার আগেই ধানের বাজার মুল্যের দরপতন হওয়ায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। বর্তমানে লালমনিরহাটে প্রতি মন ধান বিক্রি হচ্ছে ৪২০ থেকে ৪৩০ টাকা দরে। এই দরে ধান বিক্রি করলে মুলধনের অর্ধেক পাওয়া যাবে না। তাই ঈদ আনন্দ তো দুরের কথা ধানের উৎপাদন খরচও উঠছে না। এই জেলার কৃষকদের ধান উৎপাদনে বিঘা প্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। যে কারনে আনন্দের ঈদ নিরানন্দে পরিনত হয়েছে তার পরিবারে। আমজাদ হোসেন বলেন, এই দেশে কৃষকের দামতো নেই, সেই সাথে এখন কৃষকের ধানেরও দাম নেই। কৃষকরা মরলে কারো কিছু যায় আসে না। কৃষকরা ধান বিক্রি করে ঈদের আনন্দ উপভোগ করে, সেই ধানের দামও নেই।
শুধু আমজাদ হোসেনই নয়, ঈদের আনন্দ মলিন হতে হতে বসেছে লালমনিরহাট গোটা জেলার প্রতিটি কৃষক পরিবার। এ বছর লোকসানের মুখে পড়ে কৃষিকাজে আস্থা হারাচ্ছেন লালমনিরহাট জেলাসহ এ অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক। তাই লোকসান থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে ধানের ন্যায্য মুল্যের দাবী জানিয়েছেন সাধারন কৃষকরা।
সরকারী ঘোষনা মতে ১হাজার ৪০ টাকা দরে ধান ক্রয় করবে সরকার। সেখানে দাম পছন্দ হলেও পরিমানে অনেক কম। লালমনিরহাট জেলার সদর উপজেলাসহ ৫টি উপজেলা থেকে মাত্র এক হাজার মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। যেখানে কৃষক প্রতি সাড়ে ১২ মন হলেও সরকারকে মাত্র দুই হাজার কৃষক ধান দেয়ার সুযোগ পাবে। যার সিংহভাগ কৃষকই বঞ্চিত হবেন। এরপরেও রাজনৈতিক প্রভাবে প্রকৃত কৃষকরা এ সুযোগ বিগত দিনেও পায়নি। এবারেও না পাওয়ার শঙ্কা আছে বলে কৃষকরা মনে করছেন। এজন্য কৃষকরা শক্ত মনিটরিং দাবী করেন তারা।
কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের ভুল্ল্যারহাট এলাকার আরেক কৃষক মনোয়ার হোসেন নয়ন জানান, এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। এই বাজারে সেই এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করলে সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা আসে। ধান আবাদ খরচের ৪ হাজার টাকাই ঘাটতি থাকছে।
তিনি বলেন, এ বছর ঋন করে ধান আবাদ করে প্রায় অর্ধেক টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। আগামীতে তিনি আর ধানের আবাদ করবেন না বলেও জানান। এই লোকসান তিনি পুরন করবেন কিভাবে.? বছরে মাত্র একবার রমজানের ঈদ আসে। আসন্ন ঈদের বাজারে পড়েছে ধানের মন্দা ভাব। ঈদে পরিবারের সবাই নতুন কাপড় পড়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি। এবার সেই ঈদ আনন্দ আমাদের নেই। শুধু ঈদ বলেই নয়। ধান মারাই শুরু হলে স্থানীয় বাজার গুলোতে বিকিকিনি কয়েক গুনে বেড়ে যায়। কিন্তু এ বছর ঈদেও জমে উঠেনি ঈদ বাজার। ঈদের ব্যবসা নিয়েও চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। ঈদের বাজারে এখনো ক্রেতার শুন্যতা বিরাজ করছে। বিগত দিনে রমজান শুরু হলেই ঈদের আগাম কেনা কাটা শুরু হয়ে যেত এ জেলায়। কিন্তু ধানের বাজারে দরপতনের প্রভাবে মার্কেট গুলো ক্রেতা শুন্য হয়ে পড়েছে।
লালমনিরহাট জেলা শহরের প্রান কেন্দ্র মিশনমোড়ের কাপড় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মিলন জানান, আমাদের এ জেলায় ধান মারাই শুরু হলেই আমাদের বিক্রি বেড়ে যায়। কিন্তু এবছর ঈদেও আশানুরুপ ক্রেতা নেই মার্কেট গুলোতে। ধানের দাম কম থাকায় কেনাকাটায় আগ্রহ নেই কৃষকদের। ঈদের জন্য বাহারি ডিজাইনের কাপড় নিয়ে বসে থাকলেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। এবারের ঈদের বাজার তেমন একটা জমবে বলেও মন্তব্য করেন এ কাপড় ব্যবসায়ী।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিদু ভুষন রায় জানান, এ বছর ৪৮ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারন করা হলেও প্রায় ৩ হাজার হেক্টরেরও বেশি আবাদ হয়েছে। সরকার নির্ধারিত বাজার মুল্যে ধান সংগ্রহ শুরু করলে বাজারে ধানের মুল্য বাড়বে এবং এবং কৃষকরাও লাভবান হবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।