বাবার রেখে যাওয়া সামান্য জমিতে ধান চাষাবাদ করে সংসার চলে পিপলুর। কিন্তু কৃষক কার্ডে তার জমি দেখানো হয়েছে এক একরের উপরে। ফলে ঋন করে চাষ করা ধান সরকারের কাছে বিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছেন না পিপলু। ঋণ পরিশোধ ও আসন্ন ঈদের খরচ নিয়ে চিন্তিত এ চাষি। শুধু তার নয় এমন চিত্র গোটা জেলার কৃষক পরিবারে। এভাবেই বললেন আদিতমারী উপজেলার বসিনটারী গ্রামের কৃষক পিপলু।
ঈদের আগে ধান ঘরে তুলেও সরকারী গুদামে বিক্রি করতে না পেয়ে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সীমান্তবর্তি জেলা লালমনিরহাটের কৃষকরা। সরকারী ভাবে ধান ক্রয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলেও তালিকা জঠিলতায় গুদামে যাচ্ছে না কৃষকদের ধান। সামান্য কিছু কৃষক ধান দিলেও পাননি তার টাকা।
জানা গেছে, লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে প্রায় ৪৮ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩লাখ মেঃটন ধান উৎপাদিত হয়েছে বলে কৃষি বিভাগের দাবি। যার মধ্যে ২৬ টাকা কেজি দরে মাত্র এক হাজার ৪৯৩ মেঃ টন ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে ১০ হাজার ৭৩১ মেঃ টন সিদ্ধ চাল ও ৩৫টাকা কেজি দরে ৩৪৫ মেঃ টন আতব চাল কিনবে সরকার। অধিক সংখ্যক কৃষকের ধান ক্রয়ের জন্য কৃষক প্রতি ৪৮০ কেজি ধান সরকারের নিকট বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে ক্রয় কমিটি।
জেলার ৭টি গুদামে বুধবার(২৮ মে) পর্যন্ত মাত্র ৯৪ মেঃটন ধান ক্রয় করা হয়েছে। সকল গুদামে আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্রয়ের উদ্বোধন করা হলেও পুরো দমে শুরু করতে পারেনি সরকারী এ দফতরটি। জেলার পাটগ্রাম উপজেলায় গত ১৯ মে হারুন ও মিলন নামে দুই কৃষকের মাত্র ৯৬০ কেজি ধান ক্রয় করে উদ্বোধন করা হলেও আর কোন কৃষকের ধান এখন পর্যন্ত গুদামে যায়নি। ধান বিক্রির ১০ দিন হলেও ধানের টাকা পাননি কৃষক হারুন ও মিলন। ফলে ধান বিক্রি করেও বিবর্ন হচ্ছে এ দুই কৃষক পরিবারের ঈদ আনন্দ।
সরকারী ভাবে প্রতিমণ ধানের বিক্রয় মুল্য এক হাজার ৪০ টাকা নির্ধারন হলেও স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪২০-৪৩০ টাকা দরে। সরকারী গুদামে চাল দিতে চালকল মালিকরাও বাজারে ধান ক্রয় শুরু করেননি। ফলে ধানের বাজারে আসছে না কাংখিত পরিবর্তন। আসন্ন ঈদ উৎসবে পরিবারের চাহিদা মেটাতে অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে পানির দামে কষ্টে অর্জিত সোনার ফসল ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কিছু কিছু কৃষক সরকারী মুল্যে ধান বিক্রি করতে ছুটছেন জনপ্রতিনিধি থেকে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের দুয়ারে। এ ক্ষেত্রে সরকারী ভাবে ঘোষনা করা হয়েছে যেসব কৃষকের জমি ৫০ শতাংশের নিচে। এমন কার্ডধারী কৃষকরা সরকারী গুদামে ধান বিক্রির যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তবে কৃষি বিভাগ বা ইউনিয়ন পরিষদের দেয়া তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হতে হবে। অন্যথায় এ সুযোগ পাবেন না কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, কয়েক বছর আগে কৃষি বিভাগ কৃষকদের কৃষি কার্ড করে দেন ভর্তুকির বীজ সার প্রদানের জন্য। সেই সময় কার্ডে উল্লেখিত জমির পরিমান অনুযায়ী কৃষক সার ক্রয় করতে পারতেন। তাই সারের চাহিদা মেটাতে কম জমির বর্গা চাষিরাও অধিক সংখ্যক জমি দেখিয়ে কার্ড করেছেন। যার ফলে জেলার আয়তনের চেয়েও কৃষকের জমির পরিমান বেড়েছে বলেও কয়েকগুন। ইচ্ছামত জমি দেখিয়ে কৃষক কার্ড করা বর্গাচাষিরাও পড়েছেন অনেকটা বিপদে। ঋন করে অল্প জমিতে ধান করেও কার্ডে ভুলের কারনে তারা ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারছেন না।
এ ছাড়াও অনেকেই ধান চাষ না করেও তাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে ধান বিক্রির খাতায়। ফলে প্রকৃত চাষিরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাতীবান্ধা উপজেলার সিঙ্গিমারী ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য রমজান আলীর পরিবার থেকেই ৫ জনের নাম কৃষক তালিকায় স্থান পেয়েছে। ওই তালিকায় তপন ঘোষ নামে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও আজিজার রহমান নামে সেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতার নাম স্থান পেলেও বাস্তবে তারা একটি ধানও উৎপাদন করেননি। এদের সাথে জনপ্রতিনিধি ও কৃষি বিভাগের সখ্যতা রয়েছে বলেও কৃষকদের অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে সিঙ্গিমারী ইউনিয়নের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ডালিম কুমার সরকার জানান, ওই ব্যক্তিদের নামে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তালিকা দিয়েছেন। তবে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দুলু'র দাবি, তিনি নন, কৃষকের তালিকা করেছেন কৃষি বিভাগের লোকজন।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, সরকারী ভাবে ধান ক্রয়ের কোন অনিয়ম মেনে নেয়া হবে না। ইউএনওদের মাধ্যমে প্রতিটি ক্রয় কেন্দ্র মনিটরিং করা হচ্ছে।