হাসপাতালের নোংরা পরিবেশ বিষিয়ে তুলছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের জীবন। নোংরা পরিবেশের কারণে হাসপাতালের ভিতরে পা রাখলেই দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ভালো চিকিৎসা পেতে গ্রাম থেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরা ছুটে আসেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার এই হাসপাতালে।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা কয়েকজন রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, অনেকটা অবহেলার কারনেই নিয়মিত পরিষ্কার না করায় হাসপাতালের টয়লেট গুলোর অবস্থা এতই নাজুক যে, হাসপাতালের গেটে পা রাখলেই টয়লেটের দুর্গন্ধ নাকে আসে এবং দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। দুর্গন্ধে এক মিনিটও টেকা যায় না সেখানে। এতে করে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে রোগীসহ রোগীর সাথে আসা স্বজনদের।
সরে জমিনে গেলে দেখা যায়, হাসপাতালের ভিতরে শিশুদের জন্য একটি আলাদা ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। কিন্তু সেই ওয়ার্ডের পাশেই রয়েছে টয়লেট। যা কয়েকমাস থেকে পরিস্কার করা হয় না। টয়লেটের দুর্গন্ধের কারণে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। টয়লেটের ভেতরে ঢুকে দেখা যায় যেন গত ৩ মাসেও একবার পরিষ্কার করা হয়নি সেই টয়লেটটি।
পাশেই রয়েছে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা আরো দুইটি বিভাগ। ওই বিভাগের টয়লেটসহ জামা কাপড় পরিষ্কার এবং গোসল করার স্থান এতটাই স্যাঁতসেঁতে ও নোংরা যেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। এমন সময় চোখে পড়ে টয়লেটে যাওয়া দুর্গন্ধে একজন মহিলা বমি করছেন। তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করলে তার বলেন তহমিনা খাতুন। তিনি জানান, আজকেই জ¦র আসায় তার ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তিনি জানতেন না হাসপাতালের পরিবেশ এত নোংরা। এই নোংরা পরিবেশের কারণের দুর্গন্ধ সৃষ্টি হওয়ায় তার বমি হচ্ছে।
একই চিত্র হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডেরও। বারান্দার ছড়ানো-ছিটানো ভাতসহ কাদামাটি মাখা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। একটু বৃষ্টি হলেই বৃষ্টির পানি ভিতওে প্রবেশ করায় পা পিচলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সেই সাথে গ্রীলের বাইরে থেকে আসছে পচা গন্ধ। কুকুরসহ কয়েকটা বিড়ালও ওয়ার্ডের ভেতরেই ঘোরাঘুরি করছে। ওয়ার্ডের টয়লেট গুলো দেখে মনে হবে যেন সেটি কোনো দিন পরিষ্কার করা হয় না। হাসপাতালের নিচতলার জরুরী বিভাগের পাশে আরো একটি কুকুর শুয়ে ঘুমাচ্ছে। জরুরী বিভাগে সব সময় ডাক্তার পাওয়া যায় না। মালি আর নাইটগার্ড দিয়ে চলছে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। দ্বিতীয় তলায় উঠলে মহিলা ওয়ার্ডের পাশের অবস্থা আরো খারাপ। শৌচাগারসহ আশপাশে ময়লা এবং পচা ভাতে ভরে আছে নর্দমা।
সাধারণত রোগীদের জন্য একটু বাড়তি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দরকার বলে পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। অথচ হাসপাতালের এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। হাসপাতালটির বিভিন্ন ওয়ার্ডের টয়লেটের মলমূত্র যাওয়ার পাইপগুলো ফাটা ও ভাঙা থাকায় চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে মলমূত্র। ফলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে পুরো হাসপাতালে। এসব মলমূত্রের ওপর বসছে নানা ধরনের কীটপতঙ্গ। যা থেকে ছড়াচ্ছে রোগজীবাণু। আর এর মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে এসে আরো নতুন কোন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন রোগী ও তাদের সঙ্গে আসা স্বজনরা। সব মিলিয়ে দুর্গন্ধে হাসপাতালে ভেতরে বসে থাকা দায় হয়ে পড়েছে রোগী ও তাদের স্বজনদের জন্য। বাধ্য হয়ে নাক-মুখ চেপে ধরে বসে থাকতে দেখা গেছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। এমনকি হাসপাতালটির ডাক্তার ও নার্সদের কক্ষের পাশ থেকেও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে যা তারা জেনেও না জানার ভাব করে ডিউটি করছেন। অথচ একজনও এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে হাসপাতালে আসা রোগীদের সেবা দেয়া অসম্ভব। মাছি, কাক ও বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে হাসপাতালে। এর মাধ্যমে রোগীদের খাবার, কাপড়সহ বিভিন্ন স্থানে এসব জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। এই জীবাণু থেকে ডায়রিয়া, জন্ডিস ও টাইফয়েড-জাতীয় রোগ হতে পারে বলেও অনেকে জানিয়েছেন। রোগীরা এক রোগের চিকিৎসা নিতে এসে অন্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অসুস্থ হচ্ছেন রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনরাও।
অভিযোগ রয়েছে, এসব দেখ ভাল করার দায়িত্ব আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা নাঈম হাসান নয়ন নামে একজন ডাক্তার থাকলেও তিনি সকালে ও রাতে একবার করে এসে শুধু রোগী দেখে চলে যান। দিনের বাকি সময় তার চেম্বারে প্রাইভেটে রোগী দেখেন এবং ক্লিনিকে বিভিন্ন অপারেশনে ব্যস্ত থাকেন। তিনি হাসপাতালে আসা রোগীদের সময় দেন না।
আফরোজা আক্তার নামে এক মহিলা রোগী বলেন, রোগীর স্বজনদের অনেকেই এখানে রান্নাবান্না করেন। আবার হাসপাতালও খাবার দেয়। কখনো তো এসব নষ্ট হতেই পারে। ময়লা ফেলার জন্য সব সময় বেডের নিচে বালতি থাকে না। এ কারণে এখানে-সেখানে ফেলতে হয় পচা ভাত। এগুলো আবার হাসপাতালের লোকজন ঠিকমতো পরিষ্কারও করে না। যার কারণে এই হাসপাতালের পরিবেশ দিন দিন খারাপ হতে চলেছে। এ কারণে অনেক রোগী হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তারা বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে।
সফিয়ার রহমান নামের এক রোগী বলেন, এখানে এসেছি বাচ্চা সুস্থ্য করতে। উল্টো হাসপাতালের দুর্গন্ধে আর গুমট আবহাওয়ায় মেয়ের জ¦র ও সর্দি আরো বেড়ে গেছে। ক্লিনাররাও ঠিকমতো তদারকি করে না।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরো এক রোগী বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছি। কিন্তু জানালা খুলে রাখার কোনো উপায় নেই। জানালা খুললেই বাহিরের মল-মুত্রের প্রচন্ড দুর্গন্ধ আসে, সেই গন্ধে প্রায় বমি চলে আসার ভাব হয়। এখানকার টয়লেটগুলো যেমন নোংরা ও অপরিষ্কার, ঠিক তেমনই হাসপাতালের বাইরের পরিবেশও নোংরা।
এক শিশু রোগীর রোগীর স্বজন রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা তো এখানে সেবা নিতে আসি। এখানে চিকিৎসার মান যে রকমই হোক, এখানকার পরিবেশ আরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আশা করেছিলাম। কিন্তু এখানে বাইরে-ভেতরে সব জায়গায়রই দুর্গন্ধে টেকা দায়। কোনো সরকারী হাসপাতালে এরকম পরিবেশ মেনে নেওয়া যায় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, আমি ভাড়ায় ক্লিনারের কাজ করি। যিনি সরকারী ক্লিনার তিনি হাসপাতালে পা রাখেন না। মাস পেরুলেই শুধু বেতন তুলে নিয়ে যান। তার পক্ষে একা একা পরো হাসপাতালটি পরিস্কার করা অসম্ভব।
ওই হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডাঃ নাঈম হাসান নয়ন বলেন, আমি এই হাসপাতালে অতিরিক্ত (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্বে আছি। কিন্তু আমি আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা হিসেবে বেতন সুবিধা পাই না। যেহেতু আমি একজন চিকিৎসক তাই বাইরে রোগী দেখতেই পারি। এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। তবে হাসপাতালের নোংরা পরিবেশের কথা স্বীকার করে জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালের এই অবস্থা।
হাতীবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ রমজান আলী বলেন, হাসপাতাল এমন একটি জায়গা, যেখানে একটু-আধটু দুর্গন্ধ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। জনবল সংকটের পাশাপাশি হাসপাতালের সংস্কারের কাজ চলছে। সংস্কারকাজ শেষ হলে এবং জনবল সংকট নিরোসন হলে এরকম অবস্থা বেশীদিন থাকবে না।