হত্যা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া ও ধর্ষণের মতো নৃশংসতা চালিয়ে যে দেশটি ১১ লাখের বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করল, সেই দেশটির সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে বাংলাদেশ নমনীয় হলে চলবে না? মায়ানমার একটি ধূর্ত দেশ, এ যাবৎ কোনো চুক্তিই ওরা পালন করেনি, তাই ওদের সাথে কোনো চুক্তিই কাজে আসার সম্ভাবনা নেই। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে, সেখানে ‘সম্ভব হলে’ দুই বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসন শেষ করার কথা ছিল। সেই দুই বছর শেষের দিকে, ফলাফলও শূন্য। অর্থাৎ, ‘সম্ভব হলে’ প্রত্যাবাসন এখন ‘অসম্ভবে’ পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ‘মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় না’।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো মিয়ানমার এখন বলছে, ‘বাংলাদেশের কারণেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া যাচ্ছে না’। বর্তমানে শরণার্থী প্রত্যাবাসনে যে কোনো অগ্রগতি নেই, তার দোষ তারা বাংলাদেশের ওপর চাপাচ্ছে। দেশটির স্টেট কাউন্সিলরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ের অভিযোগ, ‘সব রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন ও নাগরিকত্ব কার্ড দেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের উদ্যোগে বাংলাদেশ সহায়তা করছে না’। সম্প্রতি জাপানে ২৫ তম ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ফিউচার অব এশিয়া’র অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। তার কথার মূল দিক হচ্ছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল, তা বাংলাদেশের কারণে সম্ভব হচ্ছে না।
রোহিঙ্গা মুসলমানরা যে মিয়ানমারের বাসিন্দা তা প্রমাণ করারও সুযোগ রাখেনি বার্মার সামরিক জান্তা। ১৯৮২ সাল থেকে সামরিক জান্তা মুসলমানদের নাগরিক ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগত অধিকার কেড়ে নেয়। ১৯৯৪ সাল থেকে জন্ম নেওয়া শিশুদের সরকারি জন্মসনদের আবেদনও প্রত্যাখ্যান করা হয়। রোহিঙ্গাদের বাদ রেখেই চালানো হয় ২০১৪ সালের আদমশুমারি। তাহলে এসব রোহিঙ্গারা কিভাবে তাদের নাগরিকত্বের পরিচয় দিবেন, আর কিভাবে দেশে ফেরত গিয়ে তাদের সহায়-সম্পদ ফিরে পাবার আশা করতে পারেন!
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করেছে একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। নিয়মিত তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছে এবং সময়-সুযোগমতো তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে। তারপর ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে চাতুরতার সাথে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিও করেছে, কিন্তু নেয়নি। এখন এটাও পরিস্কার, আন্তর্জাতিক চাপ থেকে বাঁচার কৌশল হিসেবে মিয়ানমার চুক্তি করেছিল। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ তখন যে মাত্রায় জোরালো হতে শুরু করেছিল, সেখানে তারা বরফ ঢালতে পেরেছে, এটাই তাদের সফলতা। যে ‘অবিশ্বাস্য সরলতায়’ সধূর্ত মায়ানমারের সাথে বাংলাদেশ চুক্তি করেছিল তার খেসারত তো এখন দিতেই হবে!
রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসিয়ানের যে প্রতিবেদনটি সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, অত্যাচার ও নির্যাতন নিয়ে একটি শব্দও নেই। নেই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও। এর বদলে আছে ‘মুসলিম’ শব্দটি। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ৫ লাখ। এই প্রতিবেদনেও শরণার্থী প্রত্যাবাসনে গাফিলতির জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করা হয়েছে। উল্টো শরণার্থীদের ‘সহজ ও সুশৃঙ্খলভাবে’ ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের উদ্যোগের প্রশংসা করা হয়েছে। গত মিয়ানমার সফরে পোপ ফ্রান্সিস তার ভাষণে একবারও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। এর আগে মিয়ানমারের ক্যাথলিক চার্চ তাকে বলেছিল, রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হলে তা ক্যাথলিকদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকেও একই রকম বার্তা ছিল। এ ছাড়া প্রটোকল ভেঙে প্রথমদিনই পোপের সাথে অনির্ধারিত সেনা নেতৃত্বের বৈঠক হয়েছে মিয়ানমারে। বাস্তবতায় দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনতাকে নাখোশ করতে চাননি পোপ।
ইতোপূর্বে মিয়ানমার ঘোষণা করেছিলো বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ৪৫০ হিন্দু রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে। তখন সচেতন মহলের প্রশ্ন ছিলো মিয়ানমারের এই ঘোষণা কেন? এর নেপথ্যেই বা কী? আসলে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কোনো ইচ্ছে ওদের আছে কি? রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয়ে প্রত্যাবাসনের ঘোষণাকে খুবই হতাশাজনক ও প্রহসনই ছিল মূল বিষয়। কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তখন বলেছিলেন, এসব হিন্দু রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছে, না বার্মার সেনাবাহিনীর ‘গুপ্তচর’ হয়ে ‘পেইড এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করছে?
গত ১ জুন মক্কায় ওআইসি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার কথা বলেছেন। এ ধরনের উদ্যোগ মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করবে, তাতে সন্দেহ নেই। রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমারের সঙ্গে আর কোনো চুক্তি নয়। রোহিঙ্গাদের ফেরাতে হলে দক্ষ ও কৌঁসুলি কূটনীতির সাথে সরাসরি জাতিসংঘের ব্যানারে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করতে হবে।