নারায়ণগঞ্জের বন্দর সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডলের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলেও এ ঘটনার কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি। তদন্ত অনুযায়ী, ঘটনার দিন ওই অফিসে কোনো দলিল রেজিস্ট্রিই হয়নি। গত বছরের ২২ ও ২৩ মার্চ আলোচিত এ ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হয়। প্রাথমিক তদন্তের পর ২৫ মার্চ এছহাক আলীকে সাময়িক বরখাস্তও (সাসপেন্ড) করে নিবন্ধন অধিদপ্তর।
কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পর দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে এছহাক আলী মণ্ডলকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে সংশ্নিষ্ট কমিটি। এছহাক আলী মণ্ডল এখন আইন মন্ত্রণালয়ে তদবির চালাচ্ছেন আগের পদে ফিরতে।
ভাইরাল ভিডিওর দৃশ্য অনুযায়ী, এছহাক আলী মণ্ডল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে খ-কালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় একেকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অফিসের ড্রয়ারে রাখছেন। সেইসঙ্গে টাকা যিনি দিচ্ছেন, তার নথিতে স্বাক্ষর করে সেটি ফিরিয়ে দিচ্ছেন। ভিডিওর শেষাংশে দেখা যায়, ড্রয়ারে জমা হওয়া টাকা বাঁহাত দিয়ে নিজের প্যান্টের পকেটে রাখছেন তিনি।
তবে আলোচিত-সমালোচিত এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি বলছে, অভিযুক্ত এবং সংশ্নিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারী ও দলিল লেখকদের বক্তব্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার দিন অর্থাৎ ২২ মার্চ ওই অফিসে কোনো দলিল রেজিস্ট্রি হয়নি। স্থানীয় জনগণও এ নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। কবে এ ভিডিও ধারণ করা হয়েছে, তাও স্পষ্ট নয়। ভিডিওচিত্র সম্পর্কে দক্ষ কারিগরি জ্ঞান না থাকায় এর চেয়ে বেশি কিছু তদন্তে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এ ঘটনার পেছনে অফিস পরিচালনার ক্ষেত্রে সাব-রেজিস্ট্রার এবং দলিল লেখকদের দ্বন্দ্বের ভূমিকা থাকতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিডিওটি কোনো এক সময়ের হলেও ঘুষ বা উৎকোচ নেওয়ার বিষয় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়নি। তবে এ ঘটনায় রেজিস্ট্রেশন বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের আইআরও নৃপেন্দ্র নাথ সিকদার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে এ প্রতিবেদন নিবন্ধন অধিদপ্তরে দাখিল করেন। সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ে এই প্রতিবেদনসহ কর্মে ফেরার আবেদন করেছেন অভিযুক্ত এছহাক আলী মণ্ডল।
এ প্রসঙ্গে বরখাস্ত সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডল বলেন, 'ভিডিওটি অন্য কোনো দিনের হতে পারে। কারণ যেদিন ভিডিও ভাইরাল হয়েছে অর্থাৎ গত বছরের ২২ মার্চ কোনো দলিল নিবন্ধন হয়নি।' ভিডিওতে ধারণ করা ড্রয়ার থেকে নিজের প্যান্টের পকেটে ক্যাশ টাকা ঢোকানোর দৃশ্যচিত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এটা হেবা দলিলের টাকা। ড্রয়ারে টাকা রাখা নিরাপদ না। জায়গাটা ভালো না। তাই টাকা পকেটে নেওয়া হয়েছে।'
তবে তদন্ত কমিটির কাছে এছহাক আলী বলেছেন, কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের যড়যন্ত্রের কারণে তিনি বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। কথিত ভিডিও অনলাইনে প্রকাশের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
তদন্ত কমিটির এ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'ঘটনার তারিখ নিয়ে একটি সূক্ষ্ণ কারচুপি করা হয়েছে। ভিডিওটি গত বছরের ২২ মার্চ ভাইরাল হয়েছে। তাই ঘটনাটি একই দিনের না-ও হতে পারে। অথচ এখানে তদন্ত কমিটি ২২ মার্চকে ঘটনার তারিখ ধরে নিয়ে তদন্ত করেছে। এর ভিত্তিতে এছহাক আলীকে নির্দোষ বলা হচ্ছে। এ নিয়ে আরও তদন্ত হওয়া উচিত।
এদিকে সাব রেজিস্ট্রার এছহাক আলীর দুর্নীতির তদন্তকারী নৃপেন্দ্র নাথ সিকদারের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীন কার্যালয়সমূহে ভুয়া 'দরপত্র আহ্বান বিজ্ঞপ্তি'র মাধ্যমে ৪৬৪ জন কর্মী নিয়োগে জাল-জালিয়াতি ধরা পড়ে। বিজ্ঞাপনের নিচে নৃপেন্দ্র নাথ সিকদারের স্বাক্ষর রয়েছে। অথচ ওই বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে প্রকাশ না করেই আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে পছন্দের চার প্রতিষ্ঠানকে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনা তদন্তের জন্য কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরও বলেন, নৃপেন্দ্র সিকদারের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এছহাক মণ্ডলের বিষয়ে তার তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করা হলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
পরে এ বিষয়টি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নজরে নেওয়া হলে তিনি বলেন, 'ঘটনা যেদিনের হোক অপরাধ হয়েছে কি-না, সেটি খতিয়ে দেখা হবে। ভিডিও থাকার পরও তদন্ত প্রতিবেদন যদি সে অনুযায়ী না হয়, তাহলে ফের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে। বিষয়টি আমরা অবশ্যই দেখব।'
গত বছর ২২ মার্চ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক মণ্ডলের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক খান মো. আবদুল মান্নান স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এই আদেশে বলা হয়েছিল, 'ভিডিওতে দেখা যায়, আপনি আড়াইহাজার অফিসে খ-কালীন দায়িত্ব পালনকালে টেবিলের ওপর ফাইলের স্তূপ, প্রতিটি ফাইল স্বাক্ষর করার আগে ঘুষ নিচ্ছেন এবং পাশ থেকে একজন ফাইল এগিয়ে দিচ্ছেন আর প্রতিটি ফাইলের সঙ্গে টাকা নিয়ে ড্রয়ারে রাখছেন এবং ফাইল স্বাক্ষর করার পর টাকা আপনার প্যান্টের পকেটে ঢোকাচ্ছেন।' অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করে আদেশে আরও বলা হয়েছিল, 'ভিডিওটিতে আপনার ঘুষ নিয়ে রেজিস্ট্রি করার সত্যতা সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।'