অব্যাহত ভারি বর্ষন ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ধরলার পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধরলা পাড়ের মানুষদের মধ্যে বন্যা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে গত দুই দিনে ধরলা নদীর পানি প্রবাহ কিছুটা কমলে নদীর দুই ধারে শুরু হয় ভাঙন। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হলেও ভাঙ্গন আতঙ্ক কমেনি ধরলা পাড়ের মানুষজনের মধ্যে। ভাঙ্গন আতঙ্কে ইতোমধ্যে ধরলা পাড়ের মানুষজন তাদের ঘর বাড়ি ভেঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে।
শনিবার (২৯ জুন) লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোঘলহাট ইউনিয়নের দ্বীপচর খারুয়া গ্রামে ধরলার তীরে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করে জেলা প্রশাসন।
স্থানীয়রা জানান, গত সপ্তাহে হঠাৎ ধরলার পানি কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ার পরে গত দুইদিনে তা কমতে থাকে। এতে দ্বীপচর খারুয়া গ্রামে প্রচন্ড ভাঙন দেখা দেয়। গত দুই তিনদিনের ব্যবধানে প্রায় ১০ থেকে ২০টি বাড়ি ধরলা নদীগর্ভে বিলীন হয়। ভাঙ্গনের মুখে পড়ে খারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও খারুয়া বন্যা আশ্রয়ণ কেন্দ্র। নদী থেকে এই প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশ্রায়ন প্রকল্পের দূরত্ব মাত্র ১২৬ ফিট। এভাবে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে যেকোন মুহুর্তে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে এই দুই ভবন। শুক্রবার (২৮ জুন) দিন ও রাতে দুই দফায় দ্বীপচর খারুয়া পরিদর্শন করে দ্রুত ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ প্রদান করেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর। শনিবার সকালে ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে এটি রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ফলে ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা পায় বিদ্যালয়, আশ্রয়ণ কেন্দ্রসহ কয়েকশ বাড়ি ও ফসলি জমি। তবে এখনো আতঙ্ক কাটেনি ধরলা পাড়ের লোকজনের।
ধরলা নদীর ভাঙ্গনের তীব্রতা কমলেও আতঙ্কিত দ্বীপ চর খারুয়ার ও বোয়ালমারী গ্রামের মানুষজন। বন্যার প্রথম ধাপে ভেঙেছে বেশ কিছু বাড়ি ও ফসলি জমি। পুনরায় বন্যা বা ভাঙ্গন দেখা দিলে সব কিছু গ্রাস করতে পারে রাক্ষুসী ধরলা নদী। সামান্য জিও ব্যাগ দিয়ে সাময়িক ভাঙ্গন রোধ করলেও তা স্থায়ী হবে না বলেও স্থানীয়দের দাবি। এজন্য তারা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।
ভাঙ্গনের শিকার পরিবারগুলো পাশ্ববর্তী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও রাস্তার পাশে বা অন্যের জমিতে নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত তাদের পুনর্বাসনে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
দ্বীপচর খারুয়ার বাসিন্দা ফরিদুল, হাকিমুল্লাহ, ছামাদ, সাইফুল ইসলাম, আজগর, আফাছ আলী জানান, গত কয়েক দিনের তীব্র ভাঙ্গনে তাদের বসতভিটা ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলিন হওয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের জমিতে। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন বিদ্যালয় মাঠের এক কোনায়।
গত এক মাস আগে ধরলার ভাঙ্গনে বিলিন হয় মোঘলহাট গ্রামের সফিয়ার রহমানের বসতভিটা। ঘরগুলো সরিয়ে আশ্রয় নেন স্থানীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। সেখানে কোনো রকম একটি ঘর তুলে পরিবার পরিজনদের নিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
তিনি বলেন, একবার নয়, গত তিন বছরে তিন তিনবার বাড়ি ভেঙে ধরলার নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। গতবছর সরকারি সহায়তায় বসত বাড়ি করেছেন। সেটাও এবার ভেঙে গেছে। এ বছর বিলিন হওয়ার এক মাস হলেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে মেলেনি কোনো সহায়তা।
ধরলা নদীর কিনাড়ে মোঘলহাট গ্রামের সুরুজ আলী জানান, নদীর মুখে পড়েছে বাড়ি। কখন যে ধরলা তার বসতভিটা ভেঙে যায় এ আতঙ্কে সব সময় থাকতে হয় তাকে। বাড়ি সরানো জরুরি হলেও আশ্রয় নেওয়ার মতো কোথাও কোনো জমি নেই। সব জমি ধরলা নদী ইতোমধ্যে গ্রাস করেছে। তাই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এখন তিনি।
দ্বীবচর এলাকার বাসিন্দা সরুজ আলী বলেন, আল্লাহ ছাড়া আমাগো বাঁচানোর আর কেউ নেই। সারাক্ষণ বুকটা থর থর করে কাঁপে বাজান। কোহন (কখন) যে সব কিছু ভেঙ্গে নিয়ে যায় রাক্ষুসী ধরলা। তিনিও ধরলা নদীে ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী সমাধান দাবি করেন।
খারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ে ২০০১ সালে সরকারি ভাবে দ্বিতল ভবন করা হয়। এখন বিদ্যালয়টিতে ২৪০ জন শিক্ষার্থীর পাঠদানে রয়েছেন ৫ জন শিক্ষক। কয়েক দিনের ভাঙ্গনে আতঙ্কিত হলেও জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন রোধ করায় এখন আর ঝুঁকি নেই বললেও পানি বৃদ্ধি পেলে আবারও ভাঙ্গন শুরু হতে পাওে বলে জানান তিনি। তবে স্থায়ী ভাবে বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, খারুয়া গ্রামে ভাঙ্গন রোধে ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ৫শত জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। ধরলার ভাঙ্গনের শিকার পরিবারগুলোকে ইতোমধ্যে পুনর্বাসনে ঢেউটিন ও নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে। আরো ক্ষতিগ্রস্থ হলে ত্রাণ শাখায় বরাদ্ধ রয়েছে, প্রয়োজনে আবার ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করা হবে। তবে খারুয়া গ্রামে ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের কোনো খবর তার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে তাদের পুনর্বাসন করা হবে বলেও জানান তিনি।