কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা আর গাফলতির কারনে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহত চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতাল মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত যাচ্ছে। ফলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। অথচ শেষ বয়সে অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বরিশালের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধারা।
বিশেষ অনুসন্ধানে নগরীসহ জেলার অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধারা অভিযোগ করেন, ফ্রি চিকিৎসার জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাটের জন্যই তাদের (মুক্তিযোদ্ধা) বঞ্চিত করা হয়েছে। নতুবা এটা নিশ্চয়ই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা। মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি-এমনিতেই বরাদ্দকৃত অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ফলে এ অর্থ ফেরত না নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেন তা আগামি অর্থবছরের সাথে যোগ করে দেয়।
শেবাচিম কর্তৃপক্ষের দাবি, পরিপত্রনুযায়ী কমিটি গঠণ করতে না পারায় বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করা সম্ভব হয়নি। কেন কমিটি গঠণ করা যায়নি এমন প্রশ্নের জবাবে শেবাচিম কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন ও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার একে অপরের ওপর দোষ চাঁপিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। শেবাচিম সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলার ন্যায় বরিশালেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পরিপত্র অনুযায়ী চিকিৎসা সেবার মান ও ব্যায় যাচাইয়ের জন্য অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালের পরিচালক এবং উপ-পরিচালক, সিটি কর্পোরেশন বা মেয়রের প্রতিনিধি, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যর কমিটি গঠণ করা বাঞ্চনীয়।
ওই কমিটিতে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সভাপতি পদে এবং মেডিক্যাল কলেজের উপ-পরিচালক সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু বছর শেষ হয়ে গেলেও অদ্যবদি কমিটি গঠণ করতে পারেনি শেবাচিম কর্তৃপক্ষ। ফলে বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কোন মুক্তিযোদ্ধাকেই শেবাচিম হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়নি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বলেন, কমিটি না করার অজুহাতে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করা হয়নি। কিন্তু শেবাচিম কর্তৃপক্ষ চাইলে এই অর্থ খরচ করতে পারতেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধারা শেবাচিমে চিকিৎসা নিচ্ছেন কিন্তু তা বিনামূল্যে নয়। কেবিন ভাড়া, ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবই টাকা দিয়ে করাতে হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, পাঁচ লাখ টাকা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শুনেছি পরিপত্র অনুযায়ী আমাদের সব চিকিৎসা ফ্রি। এমনকি বাসা থেকে নিয়ে আসতে হলেও তার ব্যাবস্থাও করবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিন্তু কোথায়। এ ধরনের কোন সুযোগ সুবিধা কোন মুুক্তিযোদ্ধাকেই দেয়া হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে অনেক কিছু করার চেষ্টা করছেন। আমাদের এক পা কবরে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এটা ভেবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে বরাদ্দ করেছেন তা নিয়ে গড়িমসি করার মানে কি? তিনি (আনোয়ার) প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে বলেন, এই অর্থ ফেরত না নিয়ে বরং আগামী অর্থবছরের সাথে যোগ করে দেয়া হক। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের এই অর্থ নিয়ে অবহেলা করায় শেবাচিম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
সৈনিক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সাংবাদিক কাজী আল-আমিন বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানে সরকারী অর্থ বরাদ্দ কিংবা মহতি উদ্যোগের বিষয়ে শেবাচিমসহ জেলার প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসকরাই জানেন না। এমনকি বিষয়টি সম্পর্কে অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও অবগত নন।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি সময়ে তার সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা পিতা অসুস্থ্য হওয়ার পর তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে গৌরনদী উপজেলা হাসপাতালে ও পরে শেবাচিমে ভর্তি করা হয়। তখন বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার ব্যাপারে সরকারী উদ্যোগের বিষয়টি তিনি উপস্থাপন করায় উভয় হাসপাতালের চিকিৎসকদের সাথে তার তুমুল বাগ্বিতন্ডা হয়েছে। পরবর্তীতে নিজস্ব অর্থায়নে শেবাচিমে তার বাবার চিকিৎসা করানো হয়।
এ ব্যাপারে শেবাচিমের পরিচালক ডাঃ মোঃ বাকির হোসেন ও উপ-পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ওপর দোষ চাঁপিয়ে বলেন, পরিপত্র অনুযায়ী কমিটি গঠণ করার পরেই এ টাকা খরচ করা সম্ভব। কিন্তু বরিশাল সিটি কর্পোরেশনকে একাধিকবার চিঠি দেয়া সত্ত্বেও তারা কোন প্রতিনিধি পাঠাননি। যে কারনে টাকা খরচ করলে অডিট আপত্তি হতে পারে ভেবে টাকা খরচ করা হয়নি। সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দেয়ার প্রমান হিসেবে তারা কোন অনুলিপি দেখাতে পারেননি।
সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ খায়রুল জানান, আমাদের একজনের জন্য এটা থেমে থাকার কথা নয়; পাঁচ সদস্যর একজন না থাকলে টাকা ফেরত যাবে এটা কোন যুক্তিযুক্ত কথা নয়। তারা কোন চিঠি পাননি বলেও উল্লেখ করেন। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোঃ জাকারিয়া বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করে বলেন, শেবাচিম কর্তৃপক্ষ হয়তো বিষয়টি বুঝতে ভুল করেছে। এখানে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে আয় ও ব্যয়ের কর্মকর্তা হিসেবে শেবাচিম পরিচালকেরই এই অর্থ খরচ করার কথা।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক শেবাচিম কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিকদের বলেন, একটি টাকাও খরচ করেনি এটি কোন কথা! কমিটির অজুহাতে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা না দেয়া হয়, আর এ জন্য যদি বরাদ্দের টাকা খরচ না হয়ে থাকে সেবা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করার কথাও উল্লেখ করেন।