চার দিকে থৈ থৈ পানি আর পানি। কোথাও একটু দাঁড়িয়ে থাকবেন সেই টুকুু শুকনো জায়গাই নাই। এদিকে ঘরেও শুকনো খাবার নাই। মাচাংয়ে উপর এক দিন আন্দি অল্প অল্প করে ছাওয়া পোয়ায় দুই দিন খাই। এই কষ্টের জন্যই মনে হয় আল্লায় হামাক (আমাদের) বাঁচায়া থুইছে। তোমরা হামার ফটো না তুলিয়া হামাক একনা শুকনা খাবার দেন বাহে! বড় মানুষ না খাইলেও ছাওয়ার ঘর তো না খেয়ে থাইকপার পারে না।
টানা চার দিন বন্যার পানিতে ডুবে থাকা লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তিস্তার তীরবর্তি মহিষখোচা ইউনিয়নের পাসাইটারী ঈদগা মাঠ এলাকার ইচার আলীর স্ত্রী মর্জিনা বেগম শনিবার দুপুরে এ ভাবে শুকনো খাবারের জন্য আকুতি জানাচ্ছিলেন।
মর্জিনা বেগম জানান, টানা ৬দিন ধরে পানিবন্দি থাকায় ঘরের শুকনো খাবার শেষ হয়েছে। এভাবে পানিবন্দি থাকলেও শনিবার সকাল পর্যন্ত কোন রকম ত্রান বা শুকনো খাবার পৌছেনি। শিশু, বৃদ্ধ আর প্রতিবন্ধিদের নিয়ে অনেকটা বিপদে পড়েছেন তারা। টয়লেটগুলো ডুবে যাওয়ায় শৌচকার্যে বড় বিপদে পড়েছেন বন্যা কবলিত নারীরা। গবাদি পশুপাখি নিয়েও বড্ড বিপদে রয়েছেন তারা। ফলে কেউ কেউ নামমাত্র দামে গরু ছাগল হাঁস মুরগি বিক্রি করে দিচ্ছেন।
শনিবার দুপুর ১২টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে শুক্রবার রাত ৯টায় পানি প্রবাহ বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে শনিবার সকালে সামান্য কিছু কমেছে বলে ব্যারাজ কর্তৃপক্ষের দাবি।
স্থানীয়রা জানান, উজানের পাহাড়ি ঢলের সাথে যুক্ত হয়েছে গত ৬দিনের ভারি বৃষ্টি। এতে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার তিস্তা ও ধরলা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। এর সাথে বুধবার দিনগত মধ্যরাত থেকে তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভারি বৃষ্টিতে কিছু পরিবার মঙ্গলবার দুপুর থেকে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নৌকা বা ভেলা ছাড়া চরাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে প্রতিদিন ধেয়ে আসছে পাহাড়ি ঢল। এতে বড় সমস্যায় পড়েছেন শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধিরা।
এ বন্যায় জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, কুলাঘাট ও মোগলহাট ইউনিয়নের তিস্তা ও ধরলার নদীর চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এসব ইউনিয়ের প্রায় ৩০হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় তিস্তার তীরবর্তি এলাকার ব্রীজ, কালভার্ট ও বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধগুলো হুমকীর মুখে পড়েছে। ভেসে যাচ্ছে শত শত পুকুরের মাছ। নষ্ট হয়েছে চাষিদের বাদাম, ভুট্টা ও সবজিসহ নানান ফসল। পানি প্রবাহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় ভয়াবহ বন্যার আশংকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তিস্তার তীরবর্তি মানুষ।
চরাঞ্চলের পানিবন্দি খেটে খাওয়া মানুষগুলো শিশুখাদ্য ও নিরাপদ বিশুদ্ধ পানির সমস্যায় পড়েছেন। তিন দিন পানিবন্দি থাকলেও সরকারী ভাবে কোন ত্রান বা শুকনো খাবার পৌছানো হয়নি বলে পানিবন্দি পরিবারগুলোর অভিযোগ। তবে শুক্রবার বন্যা কবলিত কিছু কিছু এলাকায় ত্রান হিসেবে সামান্য শুকনা খাবার দেয়া হচ্ছে।
গোবর্দ্ধন বন্যা নিয়ন্ত্রন স্প্যার বাঁধ ২ এলাকার আলম বাদশা, মিজানুর রহমান জানান, আগে বন্যা হলে এক দুই দিনের মধ্যে পানি নেমে যেত। এবারের বন্যায় টানা ৪/৫ দিন ধরে পানিবন্দি হলেও এতোটুকু পানি কমছে না। আগে বন্যার শুরুতে সরকারী ভাবে শুকনো খাবার দেয়া হত এবছর সেটাও নেই। বন্যার জন্য নেয়া আগাম প্রস্তুতির শুকনো খাবার প্রায় সকল বাড়িতে শেষ হয়েছে। সবাই নিদারুন কষ্টের মধ্যে পড়েছেন শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে।
হাতীবান্ধা উপজেলার চর সিন্দুর্না গ্রামের আলতাব উদ্দিন ও আবু তালেব বলেন, এমন বন্যা তো দেখিনি। পানি শুধু বেড়েই চলেছে। ঘর বাড়ি রাস্তা ঘাট সর্বত্রই পানি আর পানি। দীর্ঘ সময় পানিতে থাকায় বাড়ির অনেকেই জ¦র শর্দ্দি ও কাঁশিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এদিকে বাজারে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট বা শিশুদের সিরাপ পাওয়া যাচ্ছে না। ওষুধ সংকট দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
আদিতমারী উপজেলা ত্রান ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মফিজুল হক বলেন, বন্যার্তদের জন্য ১২ মেঃটন জিআর চাল বরাদ্ধ পাওয়া গেছে। শুক্রবার বিকেল থেকে তা বিতরন করা শুরু হয়েছে। তবে শুকনো খাবারের প্রয়োজন থাকলে বরাদ্ধ না থাকায় দেয়া হচ্ছে না।
হাতীবান্ধা উপজেলা ত্রান ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম জানান, তার উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন তিস্তা নদীর অববাহিকায়। তিস্তায় সামান্য পানি বাড়লেই কিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েন। কিছু এলাকায় ত্রানের চাল বিতরন শুরু হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যার মধ্যে সকল ইউনিয়নে ত্রানের চাল বিতরন শেষ হবে বলে জানান তিনি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলী হায়দার জানান, জেলার ৫টি উপজেলার বন্যা কবলিতদের ত্রাণ দিতে জেলা প্রশাসন থেকে ১১০ মেঃটন জিআর চাল ও আড়াই লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। যার বিতরনও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। শুকনো খাবারের প্যাকেট পর্যাপ্ত না থাকা দেয়া যাচ্ছে না বলেও জানেন তিনি।
দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, তিস্তার পানি প্রবাহ দুপুর ১২টায় বিপদ সীমার ২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও রাতে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪ সেন্টিমিটারে পৌছে। ব্যারেজ রক্ষার্থে সবগুলো ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করা হচ্ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।