গুজব ছড়ানোর ইতিহাস বাংলাদেশে নতুন নয়। অতীতে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা নির্বাচনের আগ মুহুর্তে গুজব ছড়িয়ে উস্কানি দিয়ে সাধারণ জনগনকে ক্ষিপ্ত করা কিংবা ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময় বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দেশব্যাপী নানা গুজব ছড়িয়ে আসছে। পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিটি গুজবই মিথ্যে হিসেবে প্রমানিত হয়েছে।
বর্তমানে দেশের চলমান উন্নয়নকে বাঁধাগ্রস্থ করতে অতীতের দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারাীরা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ব্যর্থ হয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে নানা গুজব ছড়িয়ে আসছে। সর্বশেষ পদ্মা সেতু নিয়ে পূর্ব ষড়যন্ত্রের অংশহিসেবে সেইসব ষড়যন্ত্রকারীরা পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা ব্যবহারের গুজব রটিয়ে দেয়। যার কোন সত্যতা খুঁজে পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচারের (গুজব) ছড়ানোর কারণেই একশ্রেনীর সুবিধাবাদি লোকদের রোষানলে বরিশালে গলাকাটা আতঙ্কে নির্মমতার শিকার হচ্ছেন এলাকায় নতুন আসা অপরিচিত ব্যক্তি, পথের মানসিকভারসম্যহীন (পাগল) মানুষগুলো। গলাকাটা সন্দেহে গণধোলাই শিকার হচ্ছে তারা। এমনকি নিস্তার পায়নি শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসা নতুন জামাই, বিভিন্ন মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য সাহায্য নিতে আসা ব্যক্তিরাও।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ভুয়া তথ্য প্রচারকে (গুজব) কেন্দ্র করে নানাসময় দেশব্যাপী বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় বিতর্কের। এসব গুজব যেকোনও মুহুর্তে সমাজের পরিস্থিতি আরও সংকটের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এর থেকে প্রতিকার পেতে তথ্য প্রকাশ বা ঘটনার ছবি ও ভিডিও শেয়ারে সবার সতর্ক থাকাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করছেন সচেতন মহল। তাদের মতে, যেকোনও তথ্য ফেসবুকে শেয়ার করা বা প্রকাশ করার সময় খুবই সতর্ক থাকা উচিত। তথ্য প্রকাশ করার আগে একাধিকবার বিভিন্নদিক থেকে সেটা ক্রসচেক করে নেওয়া উচিত।
গুজব হল জনসাধারনের সম্পর্কিত যেকোন বিষয়, ঘটনা বা ব্যক্তি নিয়ে মুখে মুখে প্রচারিত কোন বর্ণনা বা গল্প। সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হল এমন কোন বিবৃতি যার সত্যতা কখনই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়না। গুজব হচ্ছে-ভুল কিংবা অসঙ্গত তথ্য। ভুল তথ্য বলতে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যকে বুঝায় এবং অসঙ্গতি তথ্য বলতে বুঝায় ইচ্ছাকৃতভাবে ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা। এ ছাড়া রাজনীতিতে গুজব বরাবর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে ইতিবাজক গুজবের পরিবর্তে নেতিবাচক গুজব সর্বদা অধিক কার্যকর হতে দেখা গেছে। গুজব সাম্প্রতিককালে সর্বাধিক অলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে দেশে। অবশ্য গুজবের উৎপত্তি আদিকালে। এর ব্যবহার মাঝে-মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। তবে এর আগে গুজবের ব্যবহার বর্তমানের মতো এত ব্যাপক হয়নি। আর এর দুর্বার বিস্তৃতি ঘটেছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। মানুষ যখন অবাস্তব অলৌকিক গল্পগুলো বলে তখন সবক্ষেত্রেই দেখা যায় ঘটনাটি তারা নিজের চোখে দেখেননি। তবে এমন বিশ্বস্ত একজনের কাছ থেকে শুনেছে যিনি কখনো মিথ্যা বলেন না। যিনি মিথ্যা বলেন না তিনিও আবার শুনেছেন অন্য আরেকজনের কাছ থেকে। আরেকজন আবার শুনেছে আরেকজনের কাছ থেকে। তিনি আবার শুনেছেন তার ভাসুরের ভাইয়ের সম্মন্ধীর খালাতো ভাইয়ের কাছ থেকে! এসব গুজবের ঘটনার উৎস সন্ধান করতে গেলে এর চেইন এরকম লম্বা হতেই থাকবে। কিছুকিছু ঘটনার উৎপত্তি কোথায় তা জনার জন্য এগিয়ে গেলেও তার কোনো তলা পাওয়া যায়না।
সূত্রমতে, সাম্প্রতিককালে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে জিগাতলা এলাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে হঠাৎ করেই একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল গুজব ছড়িয়ে দেয়-‘ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে চারজন ছাত্রকে মেরে ফেলা হয়েছে, একজনের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে ও চার ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে।’ এ গুজবে কান দিয়েই কোনও রকম বাদ-বিচার না করেই তা ফেসবুকে ভিডিও আকারে শেয়ার করেন অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ। মুহুর্তের মধ্যে ওই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। কয়েক ঘন্টা পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা গুজবের ঘটনাস্থল ঘুরে এসে সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, সেখানে এমন কিছুই ঘটেনি।
এর আগে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু থামাতে ‘সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে’ এমন গুজব ছড়িয়ে বলা হয় ‘যারা এ কথা বিশ্বাস করবে না তাদের ইমান নষ্ট হয়ে যাবে।’ ওই বছরের ৫ মে ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করলে রাতে তাদের হটিয়ে দেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই রাতে হেফাজতের হাজারখানেক নেতাকর্মী নিহত হওয়ার গুজব রটানো হলেও একজন ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন এমন কোন তথ্য অদ্যবর্ধি দিতে পারেনি সংগঠনটি।
গুজব ছড়িয়ে সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এমন অপচেষ্টা বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বেই নানাসময়ে করে আসছে সুবিধাবাদী একটি মহল। তাই কোনটি গুজব আর কোনটি সঠিক সংবাদ তা সবার আগে যাচাই করার কৌশল সম্পর্কে সবার সাধারণ ধারণা থাকা উচিত। পাশাপাশি গুজবে কান না দিয়ে সকলকে এখনই সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সাংসদ মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস জনকণ্ঠকে বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের সাম্প্রদায়িক চক্র গুজব রটনা ও মিথ্যাচারের প্রধান কারখানা। ‘মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং কোরআনের বাণী নিয়ে ক্রমাগত মিথ্যাচার করে যাওয়া এই সাম্প্রদায়িক চক্রের কালো থাবা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে রক্ষা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার আগেও গুজব রটনার অপসংস্কৃতি ছিলো। সাম্প্রতিককালে ইন্টারনেটে সামাজিক গণমাধ্যম আসার পরে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে। আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক মহল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুজব রটিয়ে একের পর এক মিথ্যাচার করে যাচ্ছে।
গুজব ছড়ানোর সুস্পষ্ট অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের পক্ষে কেউ কেউ অবস্থান নেওয়ার তাদের কঠোর সমালোচনা করে বীর মুক্তিযোদ্ধা তালুকদার মোঃ ইউনুস আরও বলেন, এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, মূলধারার গণমাধ্যম এখানে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। ফেসবুকসহ সামাজিক গণমাধ্যমের পবিত্রতা যদি রক্ষা করতে চান তাহলে গুজব রটনাকারীদের কালো থাবা থেকে রক্ষা করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য, পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করার জন্য বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে গুজব রটানো হচ্ছে উল্লেখ করে দুইবারের সাবেক সাংসদ তালুকদার মোঃ ইউনুস বলেন, ফেসবুকে যারা বেনামে পোস্ট দেয়, তারা দেশের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, গণমাধ্যমের শত্রু। দেশের চলমান উন্নয়নের ধারা ব্যহত করতেই তারা একের পর এক গুজব ছড়িয়ে সাধারণ জনগনকে বিভ্রান্তিতে ফেলার চেষ্ঠা করছে।
পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের দাবি ॥ পদ্মা সেতু নির্মাণে এক লাখেরও বেশি মানুষের মাথা লাগবে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো প্রসঙ্গে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে-আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এটি একটি গুজব। এর কোনো সত্যতা নেই। এমন অপপ্রচার আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য দেশবাসীকে অনুরোধ করা যাচ্ছে।