সুজানগরের ইতিহাস খ্যাত এক হিন্দু জমিদারের নাম বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী। আনুমানিক আড়াই’শ বৎসর আগে উপজেলার তাঁতীবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম গুরু গোবিন্দ চৌধুরী। তৎকালীন নাটোর কালেক্টরির সেরেস্তাদার উপেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী তাঁতীবন্দের জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তদবংশীয় খ্যাতিমান পুরুষ বিজয় গোবিন্দ চৌধুরীর শাসনামলেই তাঁতীবন্দসহ আশপাশের এলাকায় তাদের জমিদারিত্বের প্রভাব প্রতিপত্তি ছড়িয়ে পড়ে। অত্যন্ত দক্ষ এবং প্রতিভাবান বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী অতি অল্প সময়ে জমিদারিত্বের হাল ধরে তাঁতীবন্দসহ আশ-পাশের এলাকায় হাজার হাজার বিঘা জমি ক্রয় করে তাঁর জমিদারিত্বের বিস্তৃতি এবং প্রসার ঘটান। মূলতঃ বিজয় গোবিন্দ চৌধুরীর কার্যকালেই তাঁতীবন্দসহ পাবনা জেলার সর্বত্র তাদের জমিদারিত্বের উত্থান ঘটে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মাস্টার বলেন, জমিদার বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী অত্যন্ত কঠোরহস্তে এবং নিয়ম-নীতির ভিত্তিতে তার জমিদারী দরবার পরিচালনা করতেন। তিনি যেমন ছিলেন একজন কঠোর প্রশাসক, তেমনি ছিলেন একজন উদার, মহৎ তথা আদর্শ মানুষ। তিনি তার শাসন আমলে সামর্থবান প্রজার খাজনা পরিশোধে যেমন বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। তেমনি আবার দরিদ্র এবং দুঃস্থ প্রজার হাজার হাজার খাজনা মওকুফ করে দিতেন। তবে তিনি যেহেতু হিন্দু জমিদার ছিলেন সেহেতু তার জমিদারি এলাকায় মুসলীম সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠানে কিছুটা নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিশেষ করে মুসলমানরা তার মাটিতে গরু জবাই বা কোরবানী দিতে পারতেন না। বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী অত্যন্ত সৌখিন জমিদার ছিলেন। তাঁর জমিদারী আমলে তিনি একাধিক হাতি এবং হরিণসহ বিভিন্ন দর্শনীয় পশু-পাখি লালন-পালন করতেন। তবে ব্যয়বহুল হাতি পালনের জন্য প্রজাগণের কাছ থেকে তিনি হস্তীপালন ফি বা বাজে জমা আদায় করতেন। প্রজা সাধারণও আমোদ-উৎসব ভোগ করার জন্য বিনা বাক্য বিনিময়ে বাজে জমা প্রদান করতেন। জমিদার প্রাসাদে থাকা ওই হাতি নাচের পাশাপাশি অনেক সময় হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে প্রজাসাধারণের জান-মাল রক্ষার কাজেও ব্যবহৃত হতো। জমিদার বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী এলাকায় একজন দক্ষ শিকারী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি শিকার উপলক্ষে জমিদার দরবার থেকে প্রচুর অর্থও ব্যয় করতেন। এলাকার শিক্ষাবিদ আব্দুল হালিম জানান, বিজয় গোবিন্দ চৌধুরীর শিকার প্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে ভারতের তদানিন্তন বড় লাট লর্ড মেও বাহাদুর তাঁতীবন্দ শিকারের জন্য শুভাগমন করেছিলেন। সেই সাথে ওই সময় ভারতে সিপাহী বিদ্রোহকালে বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী ভারতের সরকার বাহাদুরকে সহযোগিতা করায় আস্থাভাজনও হয়েছিলেন। তিনি তাঁর জমিদারিত্বের কার্যকালে শত বিঘা জমির উপর জমিদার বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। বিশাল এবং বিলাশবহুল মনোমুগ্ধকর ওই বাড়ীর এক তৃতীয়াংশ জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছিল অত্যাধুনিক ডিজাইনের একাধিক অট্রালিকা, দিঘি এবং দু’টি দৃষ্টিনন্দন সুউঁচু মঠ। পাবনা জেলার প্রতিটি মানুষের কাছে মঠ দু’টি ছিল বিজয় বাবুর মঠ নামে পরিচিত। অত্যন্ত কারুকার্যময়, দৃষ্টিনন্দন এবং ব্যয়বহুল ওই মঠ দু’টি দেখতে প্রতিদিন স্থানীয় হাজার হাজার পর্যটক বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী বাড়িতে ভীড় করতেন। তবে কালের পরিক্রমায় এবং সময়ের বিবর্তনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত তথা বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী পরলোকগমন করায় বর্তমানে তার জমিদারিত্বের ইতিহাস এবং সকল কর্মযজ্ঞ শুধুই স্মৃতি বলে তাঁতীবন্দ ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মৃধা জানান।