‘কি কবো (বলবো), হাত-পা শুকায়ে আসতিছে চিন্তায়। নিজে খাবো কি, গরুক (গাভী) খাওয়াবো কি,লোন শোধ করবো কোন (কোথায়) থেকে? আমরা (খামরাীরা) শ্যাষ (শেষ) হয়ে যাবনে (যাব)। কথাগুলো বলছিলেন পাবনার চাটমোহরের গরুর খামারী মামুন হোসেন।
ব্র্যাক ডেইরি চিলিং সেন্টারে গত তিন দিন দুধ সরবরাহ করতে না পারায় কথাগুলো বলেন তিনি। ব্র্যাক ডেইরি চিলিং সেন্টার দুধ সংগ্রহকারী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। রবিবার (২৮ জুলাই) বিকাল থেকে ব্র্যাক ডেইরি চিলিং সেন্টার, প্রাণ ডেইরি চিলিং সেন্টার,আকিজসহ উপজেলাস্থ সব ডেইরি চিলিং সেন্টার স্থানীয় খামারীদের কাছে থেকে দুধ সংগ্রহ বন্ধ রেখেছে। পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, ক্রয়- বিক্রয়ের উপর ৫ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এরপর থেকেই উপজেলার ডেইরি চিলিং সেন্টারগুলো দুধ সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। এর প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারে। একদিনের ব্যবধানে দুধের দাম লিটারে কমেছে ৩০-৩৫টাকা। সোমবার (২৮ জুলাই) সকালে চাটমোহর নতুন বাজার ও পুরাতন বাজারে দুধ বিক্রি হয়েছে লিটার প্রতি ১৫-২০টাকা। দুইদিন আগেও দাম ছিল ৫০-৫৫টাকা লিটার।
উপজেলার পৈলানপুর গ্রামের বাসিন্দা মামুন জানান,তার খামারে গবাদি পশু আছে মোট ২২টি। এর মধ্যে গাভী রয়েছে ১০টি। ৭টি গাভী বর্তমানে দুধ দিচ্ছে। দৈনিক গড়ে ৭০কেজি দুধ দেয় গাভীগুলো। ব্র্যাক ডেইরি চিলিং সেন্টার থেকে সপ্তাহে ৪২০লিটার দুধের বিল (দাম) তোলেন ১৫ হাজার ১২০ টাকা। ৩৬টাকা দরে দুধ সরবরাহ করেন ওই প্রতিষ্ঠানে। তিনি জানান, ৭০লিটার দুধের পেছেন খরচ হয় ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২৫০টাকা। ঘাস ও খড়, খৈল-ভূসি কেনা, গরু পরিচর্যা ও দুধ পরিহবন বাবদ এ টাকা খরচ হয়। ৪২০ লিটার দুধে খরচ হয় ১৩ হাজার ১৯৯টাকা। লাভের টাকায় চলে সংসারের খরচ। মামুনের ভাষ্যমতে, খামারের জন্য তিনি ব্র্যাকের কাছে থেকে ঋণ নিয়েছেন ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মাসে তাকে ২২ হাজার টাকার কিস্তি দিতে হয় ঋণ পরিশোধের জন্য। দুধ বিক্রি থেকেই আসতো এ টাকা।
শুধু মামুনই নয়, দুধের বাজারে দামের ধস নামায় ঈদের আগে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন উপজেলার গরু খামারীরা। বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। একাধিক খামারী বলছেন, ডেইরি চিলিং সেন্টারগুলো দুধ সংগ্রহ ফের শুরু না করলে আন্দোলনে নামবেন তারা।
উপজেলায় খামারির সংখ্যা ৩২৮জন। এদের খামারে ২৫ হাজারের বেশি গাভী রয়েছে। প্রতিদিন ৬০ হাজার লিটারের বেশি দুধ পাওয়া যায় এসব গাভী থেকে। এর মধ্যে খামারীদের কাছে থেকে প্রাণ ৩৫ হাজার লিটার,আড়ং ১৭ হাজার লিটার,মিল্কভিটা ৫৭০ লিটার দুধ দৈনিক সংগ্রহ করে। স্থানীয় ফারুক ডেইরি হার্ব ও স্থানীয় একজন ব্যক্তি ৩ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করেন। বার্ষিক ৪৪ হাজার মেট্রিকটন দুধ পাওয়া যায় এসব খামার থেকে। এ খতিয়ান চাটমোহর উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা ও মিষ্টিদ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও গড়ে দৈনিক ৪ হাজার লিটার দুধ কিনে থাকেন খামারীদের কাছে থেকে।
ব্র্যাক ডেইরি চিলিং সেন্টার, পৈলানপুর শাখার ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, কি কারণে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ দুধ সংগ্রহ বন্ধ রাখা হয়েছে। চাটমোহর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দিন বলছিলেন,হাইকোর্টের নির্দেশ। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। তিনি বলেন,সবারই উচিত খামারীদের সঙ্গে থাকা। তিনি জানান, এক লিটার দুধ উৎপাদনে বর্তমান বাজার খরচ ২০টাকা। অথচ বাজারে আজকে (২৯ জুলাই) দুধ বিক্রি হয়েছে ২০টাকা।
এই উপজেলার গো-খামারীরা দুধ বিক্রি না করতে পেরে প্রতিদিন ২০ লক্ষাধিক টাকা লোকসান গুনছেন। এভাবে সপ্তাহ ব্যাপী দুধ ক্রয়কেন্দ্র গুলো দুধ সংগ্রহ বন্ধ রাখলে খামারীদের কোটি টাকা লোকসান শুনতে হচ্ছে। গো-খাদ্র্যের অগ্নিমূল্যে বাজারে হঠাং করে দুধ বিক্রি বন্ধ থাকায় খামারীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
প্রাণ কোম্পানি শুধুমাত্র চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলার ২২টি হ্যাবের মাধ্যমে প্রতিদিন ৩২ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করছেন। ব্র্যাক, মিল্ক ভিটা, আকিজ ও এসিআইসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মিলে প্রতিদিন এ উপজেলায় থেকে প্রতিদিন দুধ সংগ্রহ করছেন প্রায় ৫০ হাজার লিটার। যার বর্তমান বাজার মূল্যে প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা। খামারীরা সোমবার সকালে রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ জানানো ছাড়াও করেছে মানববন্ধন। খামারীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।