১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কাল রাতে গুটি কয়েক বিপথগামী ঘাতক সেনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার স্বপরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যার পাশাপাশি ওইরাতে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর বোন জামাতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাসায় হামলা চালায়।
সেইদিন ঘাতকের নির্মম বুলেটে বরিশালের সাতজন শহীদ হন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর বোন (রব সেরনিয়াবাতের স্ত্রী) আমিনা বেগম, বর্তমান বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি’র সহধর্মিনী শাহানারা বেগম, ছোট ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতসহ নয়জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুত্বর আহত হয়েছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি বলেন, স্বাধীনতার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-ই ছিলেন পুরোধা। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে অন্যায়ের সাথে তিনি কখনই আপোষ করেননি। বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী হিসেবে আমার বাবা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সহজ, সরল ও নিরহঙ্কারী। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় তার মনেও দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো বাংলার মানুষ তাকে কখনও মারতে পারেনা। তাইতো সেদিন (৭৫’এর ১৫ আগস্ট রাতে) বাসার বাহিরে গুলির শব্দ পেয়েই দোতালা থেকে তিনি নিজেই নিচতলায় নেমে এসেছিলেন।
ঘাতকের নির্মম বুলেটে সেইদিন বরিশালের যারা শহীদ হয়েছিলেন....
আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ॥ বরিশাল জেলার তৎকালীন গৌরনদী উপজেলার (বর্তমান আগৈলঝাড়া) সেরাল গ্রামের আব্দুল খালেক সেরনিয়াবাত ও মোসাম্মৎ ফকুরুনন্নেসা বেগমের ঘর আলোকিত করে ১৯২১ সালের ২৮ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। আব্দুল খালেক সেরনিয়াবাত ছিলেন গৈলা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত গৈলা মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৩৯ সালে সরকারী বৃত্তিসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৪১ সালে সরকারী বৃত্তিসহ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে তিনি বিএ পাশ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল’ ডিগ্রী লাভ করেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ছিলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। তারা একসাথে হোস্টেলেও থেকেছেন। বঙ্গবন্ধুর সেজ বোন আমিনা বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। বরিশালে আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১২ এপ্রিল তিনি কৃষিমন্ত্রী হন। ১৯৭৩ এর নির্বাচনেও জয়লাভ করার পর বঙ্গবন্ধু তাকে সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী নিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার ও উৎপাদনে এবং কৃষকদের সহায়তা দেওয়ায় তার ভূমিকা ছিল জোড়ালো। একজন সৎ আদর্শবান ব্যক্তি হিসেবে তিনি সব মহলে প্রশংসিত ছিলেন। তিনি ছিলেন বরিশাল প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে তিনি শহীদ হন। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বরিশাল প্রেসক্লাবের নতুন নামকরন করা হয়েছে “শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাব”। বরিশালের বিভাগীয় স্টেডিয়ামসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার নামে। জীবদ্দশায় আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের শেষ স্বপ্ন ছিলো গৌরনদীকে জেলায় রূপান্তরিত করার।
বেগম আরজু মনি ॥ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ কন্যা আরজু মনি ১৯৪৭ সালের ১৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। বরিশাল সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও বিএ পাস করেন। ১৯৭০ সালে খালাত ভাই শেখ ফজলুল হক মনির সাথে তার বিয়ে হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। দুই সন্তানের জননী বেগম আরজু মনিকে অন্তঃসত্তা অবস্থায় স্বামীর সাথে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকেরা।
বেবী সেরনিয়াবাত ॥ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত ১৯৬০ সালের ২০ মে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। ঘাতকরা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সাথে তাকেও (বেবী সেরনিয়াবাত) নির্মমভাবে হত্যা করে।
আরিফ সেরনিয়াবাত ॥ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত ১৯৬৪ সালের ২৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন। ১৫ আগস্ট ভয়াল কালরাতে বাবা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সাথে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতকেরা।
সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত ॥ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় পুত্র আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত ১৯৭১ সালের ২২ জুন জন্মগ্রহণ করেন। দাদার সাথে ঘাতকেরা চার বছর বয়সের বাবুকেও নির্মমভাবে হত্যা করে।
শহিদ সেরনিয়াবাত ॥ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ভাইয়ের ছেলে শহিদ সেরনিয়াবাত ১৯৪০ সালের ২৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বরিশাল বিএম স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। ঢাকা থেকে আইন পাস করার পর তিনি বরিশাল কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। তিনি দৈনিক বাংলা পত্রিকার বরিশালের সংবাদদাতা ও বরিশাল প্রেসক্লাবের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৫ আগস্ট চাচার বাসায় অবস্থানকালে ঘাতকের নির্মম বুলেটে তিনি নিহত হন।
নঈম খান রিন্টু ॥ সাবেক শিল্প মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই আব্দুল নঈম খান রিন্টু ১৯৫৭ সালের ১ ডিসেম্বর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বরিশাল জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। বরিশালের একটি সাংস্কৃতিক দলের সাথে ঢাকায় গিয়ে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় অবস্থানকালে ঘাতকের নির্মম বুলেটে তিনি নিহত হন।