দক্ষিণ চট্টগ্রামের পারকি সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণ পিপাসুরা এই সময়ে বেড়াতে এলে কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারবেন না। এখানে সামনে সাগরের বিশাল জলরাশি, ডানে কর্ণফুলী মোহনায় বন্দরে জাহাজের আসা যাওয়া, বহির্নোঙরে নোঙর করা জাহাজগুলোর আলোর ঝলকানি, বিস্তীর্ণ ঝাউ বাগান সব অনুষঙ্গ আছে। তবে সমুদ্র সৈকত এখন আগের মত নেই। আগে পর্যটকদের এখানে আকর্ষণ ছিল। সমাগমও ছিল। কিন্তু এখন নেই পরিবেশের কারণেই। ওই জায়গায় দুই বছর আগে ঘূর্ণিঝড়ে সৈকতে আটকে যাওয়া ৫শ ফুট দৈর্ঘ্য একটি জাহাজ বদলে দিয়েছে সৈকতের পুরো গতি প্রকৃতি।
একাধিক সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম শহর থেকে অন্তত ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে পারকি সমুদ্র সৈকত। এটি কক্সবাজারের পরেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সমুদ্র সৈকত হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সেই সৈকত এখন বিবর্ণ ফ্যাকাসে। মূল সৈকতে নেমে বামে যেখানে ক্রিস্টাল গোল্ড নামের জাহাজটি আটকা পড়েছে। সেদিকে হাঁটলে বুঝা যাবে সৈকতের কী করুণ হাল! কর্ণফুলীর মোহনা থেকে ভেসে আসা পলি জাহাজে ধাক্কা খেয়ে জমছে সাগর সৈকতে। আর তাতে সৈকতের অন্তত এক কিলোমিটার অংশে জমেছে দেড় ফুটের কাদা মাটির আস্তরণ। ফলে বালুর সমুদ্র সৈকত পরিণত হয়েছে কাদা মাটির মেঠোপথে। সৈকতের কর্দমাক্ত এই দশায় দূর দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকেরা সাগরে নামার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বালুর সৈকতে জমা কাদা মাটি দেখলে যে কারো মনে হবে পাড়া গাঁয়ের মেঠোপথ। সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়েছে সৈকতের জীব বৈচিত্র্যও। একসময় ‘লাল কাঁকড়ার সৈকত হিসাবে পারকির পরিচিতি ছিল। তবে এখন এসব কাঁকড়ার দেখা মিলছে না। কাঁকড়া সংখ্যা কমতে থাকা এ সমুদ্র সৈকতে পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রমাণ হিসাবে দেখছে পরিবেশ গবেষকরাও।
সৈকত এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন ওয়াহিদ উল্লাহ। তিনি জানান, কাদামাটি জমে সমুদ্র সৈকত পুরোপুরি সৌন্দর্য হারিয়েছে। পলি জমে আকারে অনেক ছোট হয়ে গেছে মূল সৈকত। শুধু তাই নয়; জাহাজটি থেকে বর্জ্য অপসারিত হয়ে নদীতে পড়ায় বর্তমানে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে। ঈদুল আযহার বন্ধের কারণে এ কয়দিনে কিছু ভ্রমণার্থী আসলেও সোমবার থেকে সৈকত জনশূন্য হয়ে পড়ে। ৫ বছর আগের পারকির সাথে এখনকার পারকির পার্থক্য অনেক। অন্য সৈকতগুলোর আকর্ষণ বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও পারকি যেন পেছন দিকে হাঁটছে। আটকে পড়া একটি জাহাজ ২ বছরেও সরানো যায়নি। আর তাতে সৈকত এখন ধ্বংসের পথে।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পারকি সৈকত বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি শেখ জোবায়ের আহামদ রাখঢাক ছাড়া জানালেন, সম্ভাবনাময় পারকি সমুদ্র সৈকতকে রক্ষা করতে এখনই পদক্ষেপ দরকার। ঘূর্ণিঝড়ে আটকে যাওয়া জাহাজটি সরানো সম্ভব না হওয়ায় সৈকত ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বর্তমানে সৈকতের অর্ধেক বালুচর পলি জমে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। সৈকত সৌন্দর্য্য কমে যাওয়ায় পর্যটকরাও আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে সৈকত কেন্দ্রিক দোকানের মালিকরাও লোকসান গুণছেন। দুই বছর আগে জাহাজটি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তরের আপত্তি থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্টের একটি আদেশও রয়েছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আগামি সপ্তাহে একটি চিঠি পাঠানো হবে। এর আগে ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূণির্ঝড় মোরার আঘাতে পারকি সমুদ্র সৈকতে আটকা পড়ে ‘এমভি ক্রিস্টাল গোল্ড’ জাহাজটি। এটি কাটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েও বেশিদূর আগানো যায়নি। জাহাজটি নিলামে কিনে নেয়া ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজ সৈকতে কাটার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু পরিবেশ সংগঠনগুলোর আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি।
তখন পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই পরিত্যক্ত জাহাজ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করায় দায়ে জাহাজটির ক্রেতা ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পরিশোধের নির্দেশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। সৈকতের এক হাজার ৪শ’৯১ শতাংশ এলাকার জীববৈচিত্র নষ্ট এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র ধ্বংস করার অপরাধে ওই ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে পারকি সৈকতের আধুনিকায়নে ৬৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ওই প্রকল্পে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় এখানে একটি থ্রিস্টার পর্যটন হোটেল, গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা, পর্যাপ্ত সংখ্যক ড্রেস চেঞ্জিং রুম নির্মাণ, পারকির সাথে সংযুক্ত সড়ক সম্প্রসারণ, পুরো এলাকায়ম সৈকতের ঝাউবনকে ঘিরে সৌন্দর্য বর্ধনের পরিকল্পনা ছিল। তবে ডিসেম্বর আসতে সময় আছে মাত্র ৪ মাস। এখনও কাজের কাজ কিছুই হয়নি সেখানে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জোবায়ের আহমদ বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে পারকির উন্নয়নে পর্যটন কর্পোরেশনকে ১৩ একর জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। এ জমিতে পারকির উন্নয়নে একনেক ৬৩ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্ধ দিয়েছে। বর্তমানে সেই প্রকল্পগুলো টেন্ডার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।