সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তালিকায় প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করছে সারা জীবনের জন্যে। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থাকলেও কোনভাবেই তা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকরি ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এতে সড়ক-মহাসড়কে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।
প্রতিবছর বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১০ লাখ লোক জীবন হারায় এবং ৫০ লাখ প্রতিবন্ধী হয়। বাংলাদেশে সর্বমোট মৃত্যুহারের সর্বোচ্চ শতকরা ১৪ ভাগ মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমান প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপি’র প্রায় শতকরা ২ ভাগ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের গাড়ির সংখ্যা ও মৃত্যুর আনুপাতিক হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশী। আমেরিকায় প্রতি ১০ হাজার গাড়ি দুইজন লোকের মৃত্যু ঘটায়। ওরা নিয়ম মেনে গাড়ি চালায়, ওদের রাস্তা সু-পরিসর এবং সেখানে ভূয়া লাইসেন্সের ড্রাইভার নেই। সর্বপরী ওদের ট্রাফিক পুলিশ দুর্নীতিপরায়ন নয় এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিত্রটি কেমন দেখা যাক। পাকিস্তানের প্রতি ১০ হাজার গাড়ির বিপরীতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয় ১৯ জনের, ভারতের ২৫ জনের। অথচ বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার গাড়ি ৬০ জনের মৃত্যু ঘটায়। বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার লোকের আছে মাত্র দুটি গাড়ি। নেপালে প্রতি ১হাজার লোকের আছে ৯টি গাড়ি, ভারতে ১২টি আর পাকিস্তানে প্রায় ১৪টি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে গাড়ি কম। পাকিস্তানে গাড়ির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশী। আমেরিকার মত উন্নত দেশের কথা নাইবা আনলাম। সেখানে শতকরা ৭৫ জন লোকেরই গাড়ি আছে। বিশ্বাস করার মত নয়, আমাদের হাসপাতালগুলো ২৫ ভাগ বিছানা দখলে থাকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীরা।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এটি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। একজন দক্ষ চালক সড়ক দুর্ঘটনারোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে আমাদের অন্য কারণগুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি, সড়কের অবস্থা, পথচারীদের বেপরোয়া চলাচলও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যতই ব্যবস্থা আমরা নেই না কেন, দুর্ঘটনা কমাতে পারবো কিন্তু বন্ধ করতে পারবো না। তাই দুর্ঘটনা প্রতিরোধের পাশাপাশি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব রোধে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে প্রাথমিক ও জরুরী পরিচর্যার। দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে সে অঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন হেলথ সেন্টার, সাব সেন্টার, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যকর্মীদের দুর্ঘটনা পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে বৈধ গাড়ীর সংখ্যা ১৩ লাখেরও বেশী। কিন্তু এই গাড়ির জন্য বৈধ চালকের সংখ্যা মাত্র ৮ লাখ। বাকী গাড়ি যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তাদের লাইসেন্স বৈধ নয়। অনেকের একাধিক লাইসেন্সও আছে। স্বাভাবিকভাবেই এই অবৈধ লাইসেন্সধারী গাড়ী চালকরা গাড়ি চালাতে গিয়ে আইনের ধার ধারে না, সঠিক ভাবে প্রশিক্ষিত নন এমন চালকের সংখ্যাও কম নয়।
সম্প্রতি হাইকোর্ট এক রায়ে, গাড়ী চালকের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এস.এস.সি পাশ নির্ধারণ করে এই সিদ্ধান্ত পাঁচ বছরের মধ্যে কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। মহাসড়কে রোড ডিভাইডার তৈরী ও পথচারী চলাচলের প্রয়োজনীয় স্থানে আন্ডারপাস ও স্কুল সিলেবাসে ট্রাফিক নিয়ম অন্তর্ভূক্ত করার নির্দেশনাও দিয়েছে আদালত। নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারকে মোটরযান আইনে বিভিন্ন অপরাধে সাজা ও জরিমানা বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে দুর্ঘটনা রোধে আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটির সুপারিশগুলি কার্যকর করতে হবে।
চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা, সরকারি অব্যবস্থাপনায় গাড়ী চালানোর অনুমতিপত্র প্রদান ইত্যাদি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এইসব দুর্নীতির দায় কি শুধুমাত্র চালকদের উপরই বর্তাবে ? নাকি সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানীগুলোকেও দুর্ঘটনার দায়ভার নিতে হবে ?
কোম্পানীর অধীনে যেসব চালকরা গাড়ি চালান সেসব ক্ষেত্রে পরিবহন কোম্পানীগুলোও তাদের দায় থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন না। দেখতে হবে গাড়ির ফিটনেস ছিল কিনা ? তারা কতোটা শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে গাড়ি চালানোর জন্য প্রস্তুত ? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানীগুলোকে যাত্রার পূর্বে অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে।
বর্তমান সরকার ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০২০ সালের মধ্যে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সড়ক বিভাগ মহাসড়কের ১৪৪টি স্থানকে দুর্ঘটনা প্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করে এর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৬৫ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বিভাগীয় এলাকায় ‘ইমপ্রুভমেন্ট অব রোড সেফটি অ্যাট ব্যাক স্পটস অন ন্যাশনাল হাইওয়েজ’ শীর্ষক প্রকল্পটির সিংহভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
আমাদের দেশে ড্রাইভিংকে এখনও নি¤œমানের পেশা হিসেবে দেখা হয়। বাস ও ট্রাক ড্রাইভাররা দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৬-১৮ ঘন্টাই পরিশ্রম করেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এভাবে পথেঘাটে থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী হয়। তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। যার ফলে তারা তাদের পেশায় মনোনিবেশ করতে পারেন না। এটিও দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ।
ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে চালকদের পেশাগত মানোন্নয়নের পাশাপাশি তাদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। এছাড়া চালকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ট্রাফিক আইন মেনে ভালভাবে গাড়ি চালাতে চালকের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা আবশ্যক। এই সকল বিষয়ে গাড়ির মালিক ও শ্রমিক সংগঠন এবং সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। সহনীয় মাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে প্রয়োজন দক্ষ ও শিক্ষিত গাড়ী চালক। এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।
লেখক পরিচিতিঃ
লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল